বাবার কথা (১)
When I am dead, my dearest
Sing no sad songs for me.
Plant thou no roses at my head,
Nor shady Cypress tree. ~
মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই বিশাল ধরণী পটে একটি ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে কিছু সময়ের জন্য বেঁচে থাকতে পারলেও আমরা কৃতজ্ঞ, গর্বিত। কারন একদিন সামান্য ধূলিকণার মত আমরা মিলিয়ে যাই এই মানব জগত থেকে, চলে যাই স্নেহময়ী এই ভুবনের মায়া ছেড়ে এক অপরিচিত ভুবনে। এই আমাদের জীবন ধারা, এই আমাদের কালের প্রবাহ। পরিচিত মানুষটি ফেলে যায় কিছু স্মৃতি, রেখে যায় কিছু চিহ্ন যেগুলোকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকে তার প্রিয় আপনজনেরা।
আত্মীয়তা সূত্রে, পারস্পরিক সাহচর্য অথবা একত্রে বসবাসের ফলে একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষের যে পরিচয় ঘটে, বাবার সাথে তেমনটি হবার সুযোগ আমি পাইনি। বাবার সঙ্গে আমার পরিচয় বহু দিন আগে তোলা তার কিছু ছবি, রেখে যাওয়া ব্যবহার্য কিছু জিনিস আর মা'র মুখ থেকে শোনা কিছু গল্পের মধ্য দিয়ে। আমার জীবনের যেটুকু সময়ে বাবা ছিলেন, সেই সময়ের কথা আমার আবছা আবছা মনে পড়ে। মনে হয় বিস্মৃতির কোনো এক অতল তলে হারিয়ে গেছে। মা বোনদের কাছ থেকে জানা অনেক দিন আগের কিছু সুখ দুঃখের ঘটনা আমার হারানো বাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমার অন্তরে জাগ্রত ভাসা ভাসা কিছু ঘটনার পটে আমি তাঁকে খুঁজে পাই।
আমার বাবা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্স/মাস্টার্স করেছিলেন। তারপর তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি করেন বায়ো কেমিস্ট্রিতে করাচী বিশ্ব বিদ্যালয়, পাকিস্তানে। এর মাঝেই আমার মায়ের সাথে তাঁর বিয়ে, সংসার শুরু করাচী শহরে। তারপর স্কলারশিপ নিয়ে তিনি চলে যান সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনী বিশ্ব বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই নিউট্রিশন এর উপর তিনি পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পশ্চিম পাকিস্তানে চাকুরীরত ছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে তিনি পরিবার নিয়ে ফেরত আসেন।
মা'র মুখে শুনেছি, খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ ছিলেন বাবা, সহজে রাগ করতেন না। সকলেই তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতো। বন্ধু মহলে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন এই পরিচিতিতে, "নূর, আমাদের সেই বন্ধুটি, যে কখনই কারোর সাথে পাঁচে নেই। যে কাউকে কোনো বিরক্ত করেনা, বন্ধু সুলভ অন্যায় আবদার করেনা। যার মনটা খুবই দয়ালু, মায়ায় ভরা।" বাবা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামায কালাম পড়তেন, রোজা করতেন। আর সবার জন্য মন ভরে দোয়া করতেন।
খুবই সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন তিনি, নিতান্তই স্বল্প ছিল তাঁর চাহিদা। নিজের জন্য, প্রয়োজনের এতটুকুও বেশী খরচ করতেন না। কিন্তু পরিবারের অন্য সকলের জন্য তাঁর চিন্তার অন্ত ছিলোনা। সবার সুখ সাচ্ছ্যন্দ আর প্রয়োজনের প্রতি তিনি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। সন্তানের মঙ্গল কামনায় তিনি থাকতেন অধীর। তাঁর প্রিয় রং ছিল নীল। অফিস ট্যুরে দেশের বাইরে থেকে ফেরার সময় মা'র জন্য যতোগুলো শাড়ি এনেছিলেন, তার সবগুলো ছিল নীল। এসবই মা আর আপাদের মুখ থেকে শোনা।
বাবা মায়ের মমতা আর ভালবাসায় তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারটিতে সবার ছোট ছিলাম আমি। তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট। আমি সব সময় ভাবতাম আর মনে মনে চাইতাম, বাবা যেন সবথেকে বেশী আমাকে ভালোবাসে, আদর করে। ছোটবেলায় বাবা আমাকে কখনো, কোনো কারনে বকা দেননি। স্নেহ, ভালোবাসা আর আদরের প্রাচুর্যে ভরিয়ে রেখেছিলেন আমায়। যদিও আমি বড় হয়েছি বাবা না থাকার দুঃখ নিয়ে, তবুও ঐ সুখকর স্মৃতিটুকুই আমাকে সবার চাইতে আলাদা করে রাখে। আমি সেই গর্বের অকৃত্রিম আনন্দ অনুভব করি।
উনার খুবই ভক্ত ছিলাম নিঃসন্দেহে। বাড়ীতে কেউ আমায় বকলে, সাথে সাথে বাবার কাছে গিয়ে নালিশ দিতাম। বাবা আমায় আশ্বাস দিয়ে বলতেন, বাড়ীর সকলকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। তাতেই আমার অভিমানী মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠত। প্রতিদিন বায়না ধরতাম, অফিস থেকে ফেরার পথে বাবা যেন আমার জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসেন। এই যেমন চকলেট, আঙ্গুর, আপেল, আইসক্রিম এমন কিছু।
সেই যুগের বাচ্চারা ছিল অনেক সরল, তাদের চাওয়া পাওয়া ছিল অনেক সহজ। খুব অল্পতেই তারা খুশী হয়ে যেত। বাবা যখন অফিস ট্যুরে গিয়েছিল, আমার মনে পড়ে, বিউটি অ্যান্ড দা বিস্ট রূপকথার সেই ছোট্ট মেয়েটির মত আমি আবদার ধরেছিলাম, বাবা যেন আমার জন্য একটি লাল গোলাপ নিয়ে আসে।
পিতৃকন্যার এই আনন্দঘন সম্পর্ক পরে বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। হঠাত একদিন কি জানি কি হলো। আকাশ থেকে খসে পড়া তারার মত, স্নেহ ভালোবাসার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে বাবা হারিয়ে গেলেন আমাদের কাছ থেকে। শৈশবের হেসে খেলে কেটে যাওয়া দিন গুলোর মাঝে, হঠাত একদিন তাঁকে হারিয়ে ফেললাম আমি। চারটে মানুষকে অসহায় করে দিয়ে আমাদের বাবা চলে গেলেন দূরে, বহু দূরে, এ মর্ত্য লোকের সীমা ছাড়িয়ে, অজানা এক অচিন লোকে।
তাঁর অনুপস্থিতিতে আমাদের জীবনের গল্প থেমে থাকেনি ঠিকই, তবে জীবনের পথচলা হয়েছিল দীর্ঘ আর ভারী। আমাদের জগতময় ছিল শুধু শুন্যতা আর স্মৃতি বেদনা।
স্মৃতি ভারে মোরা হেথা পড়ে আছি
ভারমুক্ত সে এখানে নেই।~
চলবে....
২য় পর্ব - বাবার কথা (২)
A wonderfully written memoir. Your excerpt has left me in tears.
ReplyDeleteThank you for keeping him alive in the heart of his children and grand children. He will always shine as the brightest star in the universe for us all.
ReplyDeleteA carefully weaved documentation of the most poignant chapter of our lives, which also highlights that our father was one of the most unique & extraordinary human being with high level of integrity.
ReplyDeleteI strongly believe that he wants us to " Decorate our lives with the flowers of memories and draw strength from it".
Thank you
He is my father in law, someone I would so loved to have familiarised myself with, having heard so many of his qualities from my in-laws as well as from my owned parents.
ReplyDeleteI feel so much for the author as it is unfair she had the least time with him among immediate family members, and that is certainly brought out very succinctly in this tribute to her father.
পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক আছে যার সূচনা কেউ নিজে করে না, শুধু ভালবাসায় লালণ করে আজীবন। বাবার সাথে এই মেয়েটির অকৃত্রিম ভালবাসার সম্পর্ককে সময় সীমাবদ্ধ করেছে --- তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। কিন্তু এও জানি, সেই অপ্রাপ্তি অন্য কেউ কখনই সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারবে না। শুধু বলব, বাবার প্রতি রইল অনেক শ্রদ্ধা, আর উনার সন্তানের জন্য অনেক অনেক ভালবাসা।
ReplyDeleteহৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া স্মৃতিচারণ। তিনি নেই, কিন্তু তাঁর সুন্দর স্মৃতিগুলো তোমাদের মাঝে আছে। তোমাদের উদারতা, মানুষের প্রতি তোমাদের ভালবাসা, সমবেদনা, জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো মনের কোণে ধরে রাখার যে প্রয়াস, এ সবকিছুর মধ্যেই তিনি আছেন।
ReplyDeleteWhat a heart wrenching yet touching memoir of my dearest grand father. An exceptional piece, portraying the gem of a personality he was. I feel much more connected to nana bhai through your writing. Thank you!
ReplyDeleteবাবা মেয়ের মধুর সম্পর্ক টা মনে হলো চোখের সামনে দেখতে পেলাম। পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসছিলো বারবার! আরো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। ❤️❤️❤️
ReplyDeleteSuch a beautiful and touching piece about my Nana Bhaiya. Though us grandchildren weren't lucky enough to meet him, I know we all feel we know him through the words of yours and everyone who knew him. In our culture, death is not the end and he remains with us all.
ReplyDeleteJoyeeta jotobar pori totobar kadi chacharcjonno. Khubee opportunities shomoy chacha ke peyechi kintu onek govir momotar bondhonguli ekhono money govir e joljol kore duerer shei taragulir ee moto
ReplyDelete