ঋতু বদল


ছোটবেলায় শিখেছিলাম ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। এর মধ্যে শরত কাল ছিল আমার খুব প্রিয় একটি ঋতু। পেঁজা তুলার মত শুভ্র, সাদা মেঘ আকাশে ভেসে বেড়ায় জলকণাকে সঙ্গী করে। প্রকৃতির অনুমতি পেলেই রিম ঝিম বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। চারিদিকে স্নিগ্ধ, প্রশান্ত ভাব মানুষের মনে সতেজতা এনে দেয়। নীল আর সাদা রঙের এমন চমৎকার আধিক্য দেখা যায় শুধু শরতের দিন গুলোতেই। শিউলি, বকুল, কামিনী, মল্লিকা এমন অনেক ফুলের সৌরভে মৌ মৌ করে চারিদিক। ছোট, ছোট পুকুর আর জলাশয় গুলোতে দেখা যায় পদ্ম ফুলের সমারোহ। আর নদীর দুই ধার দিয়ে দেখা মেলে দীর্ঘ কাশের বন। আমাদের ঋতু চক্রে শরতের স্থায়িত্ব কাল খুবই অল্প।

ভূগোলকের উল্টো পিঠে আমেরিকায় এসে জানলাম এদের ঋতু চারটি।Winter, Spring, Summer, Fall/Autumn. বাকি তিনটার ব্যাপারে ধারণা থাকলেও ফল বা অটোম ছিল আমার কাছে খুবই নতুন একটি ঋতু। দেশের শরত বা হেমন্ত কালের সাথে এর কোনো মিল নেই। 

এই ঋতুটির সব থেকে আকর্ষণীয় দিক হলো  Colors of Fall Foliage  বা গাছের পাতার রং পরিবর্তন যা দেখতে পাওয়া যায় অক্টোবার মাসে। মেপল, ওক, অ্যাসপেন,  এমন অনেক প্রজাতির গাছ শীতের প্রস্তুতি নিতে তাদের ক্লোরোফিল (সবুজ পিগমেন্ট) উৎপাদন কমিয়ে দেয়। যার ফলে পাতার অন্যান্য পিগমেন্ট গুলো প্রকট হয়ে উঠে এবং তারই বিচিত্রতা প্রকাশ পায় লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপি, খয়েরি, সোনালি এমন বিভিন্ন রং ধারণ করার মাধ্যমে। রং এর এই বিচিত্র খেলা প্রায় মাস খানেক থাকে, আর তার পরপরই পাতা গুলো ঝড়তে শুরু করে। তাই পাতা পড়া এই ঋতুটির নাম ফল  (Fall). ফলে, দিনের বেলায় নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা অনুভব হলেও সন্ধ্যার পরে ঠাণ্ডা নামে।     

১৯৯২ সালের ফলে, আমার আমেরিকায় আগমন। আসার পর থেকেই দারুণ হোমসিক থাকতাম। কলেজের লেখাপড়াটা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগতো না। দেশের সব কিছু প্রচন্ড ভাবে মিস করতাম। মানুষের মন যখন খারাপ থাকে তখন অবচেতন মনেই সে পরিচিত ব্যাপার গুলো খুঁজতে থাকে।  '৯২ এর সেই অক্টোবার মাসের কোনো এক মন খারাপ করা বিকেলে, গরম কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে এই কবিতাটি লিখেছিলাম। শীতে জবু থবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাইরের গাছ গুলোতে অবিরাম পাতা ঝরছে, আর আমার চোখ দুটো দিয়ে ঝরছে অশ্রু ধারা।
 

আমার পরিচিত আকাশটা বদলে গেলো, পরিচিত দৃশ্য গুলো আর নেই। 
হেথায় আকাশ জুড়ে তারার মেলা বসেনা
জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় ভাসে না। 
জীবনটা এক মেঘলা দিনের মত
একাকীত্ব, বিষণ্ণতা যতো, 
রুক্ষ, ধূসর মলিনতায় ঢাকা। 
এখানে মানুষগুলো শুধুই একা, আপন
যে যার মত আছে যেমন, তেমন।

আমার পরিচিত সময়টা হারিয়ে গেলো, পরিচিত মুখ গুলো আর নেই।
সকাল হতেই মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গেনা
স্নেহ ভরা শাসন যে আর কেউ করেনা। 
মাগো, তুমি কোথায় চলে গেলে,
মা যে আমার কোন দূরে তে আছে। 
আর যে আমায় কেউ করেনা বারণ
কেউ বাধেনা ভালোবাসার বাঁধন। 
আমি শুধুই পড়ে আছি একা, কবে আবার পাবো তোমার দেখা।

আমার পরিচিত আবাসটা হারিয়ে গেলো, পরিচিত ক্ষণ গুলো আর নেই।
জানালার পাশে নিম গাছের ডালে
যেথায় ছিল এক শালিকের বাস, 
জোড়ের খোঁজে ছিল তার কিচির মিচির ডাক। 
সে ডাক এখন অনেক, অনেক দূরে
আমি হেথায় পড়ে আছি সব কিছু ছেড়ে।
আর শুনিনা ফেরিওয়ালার হাঁক। 
মুয়াজ্জিনের আজান দেয়না সাড়া, নামায যে আর পড়তে নেই তাড়া।

আমার পরিচিত কথা গুলো হারিয়ে গেলো, পরিচিত শব্দ গুলো আর নেই।
বিজন দেশের বিজন ভাষায় কথা
মনের ভিতর জমাট, জমাট ব্যাথা। 
যন্ত্রণারা কথা বলে যায়
অশ্রু ঝরে, শেষ খুঁজে না পায়।
এইতো জীবন এমন ধারায় চলে
হাসি কান্না মিলেমিশে আসে।
এরই মাঝে দিন কেটে যায় মোর; রাত কেটে যায়, আবার আসে ভোর।    

Comments

  1. This beautiful post and the very thoughtful poetry reminds me of John Keats poem "The Human Seasons", where he describes the similarities between the four seasons and the human mind.
    Love the sensitivity that has been delicately expressed in your poem.

    ReplyDelete
  2. নতুন দেশে এসে মাতৃভূমির এই মায়া, স্বজনের অনুপস্থিতি আমরা অনুভব করি। বিদেশে নিজের সেই প্রথম বছরের জীবন ভেসে উঠল মনের ভেতরে। এখন আমাদের সময়ের সেই বাংলাদেশ আর নেই, সব বদলে গেছে। কিন্তু এই কবিতা পড়ে মনে হল আজও মনের ভেতরে জীবিত আছে হারিয়ে যাওয়া আমাদের স্মৃতির বাংলাদেশ। অনেক ভাল লাগলো!!!

    ReplyDelete
  3. প্রবাসীদের মনের কথা এ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে।

    ReplyDelete

Post a Comment