কলম্বাসের আমেরিকা
অক্টোবার মাসের দ্বিতীয় সোমবারে সারা আমেরিকা জুড়ে উদযাপিত হয় কলম্বাস ডে। স্মরন করা হয় বিশ্ব বিখ্যাত নাবিক 'ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে' যিনি একদা আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। তবে আমেরিকার ইতিহাসে এই ঘটনাটির ব্যাপারে অনেক মতবিরোধ আছে, যা বছরের পর বছর অসংখ্য তর্ক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এটি কি আসলেই আমেরিকানদের জন্য একটি স্বর্ণ উজ্জ্বল দিন, নাকি অনেক গুলো মানুষের রক্ত ক্ষরন আর বলিদানের কালো অধ্যায়? এই বিষয় নিয়ে অতীতে ঐতিহাসিকরা প্রচুর গবেষণা আর বিশ্লেষণ করেছেন। একেক জন গবেষক একেক রকম মনোভাব প্রকাশ করেছে যা কলম্বাস ডে এর পক্ষে ও বিপক্ষে দুই দিকেই কাজ করেছে। আর সেজন্যই আমেরিকার পঞ্চাশটি স্টেটের মধ্যে কোনো কোনোটিতে এটি সরকারী ছুটির দিন, কোনো কোনোটিতে এটি ঐচ্ছিক বা অপশনাল ছুটি।
ইটালিয়ান বংশোদ্ভূত নাবিক কলম্বাস চাকরী করতেন স্পেনের রাজা আর রানীর অধীনে। তিনি বরাবরই সাহসী আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যখন ইউরোপিয়ান এক্সপেডিশনের প্রতিযোগিতা চলছিল, উনার মাথায় তখন ঘুরছিল কি করে এশিয়া আবিষ্কার করা যায়। আর তা করতে পারলে কলোনাইজেশনের মানদণ্ডে স্পেন হবে আরো শক্তিশালী। অন্যদিকে তিনি এটাও ভাবছিলেন, স্বর্ণ, মুক্তা আর মসলা ট্রেডিং এর মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে লাভ করবেন অধিক মুনাফা।১৪৯২ সালে কলম্বাস রওনা হয়েছিলেন চায়না আর ইন্ডিয়া আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে, যাতে তিনি তার প্ল্যান মাফিক স্বর্ণ আর মসলা নিয়ে ফেরত যেতে পারেন। কিন্তু ভুলক্রমে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তিনি এসে পড়েছিলেন বাহামা দ্বীপপুঞ্জে। আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকান আদিবাসীদের। এরপর আরও তিনবার তিনি এসেছিলেন এই ভূখণ্ডে, তবে সাউথ আমেরিকা, সেন্ট্রাল আমেরিকা ও ক্যারেবিয়ান্স আইল্যান্ডে। মেইনল্যান্ড বা নর্থ আমেরিকাতে তিনি কখনোই আসেননি।
কলম্বাস ছিলেন চৌকস আর কৌশলী। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হবে, এই মন্ত্র তিনি জানতেন। মশলাপাতি আর মূল্যবান সোনাদানার পরিবর্তে তিনি আমেরিকান আদিবাসী বা নেটিভ আমেরিকানদের দিয়েছিলেন ইউরোপ থেকে আনা জীবজন্তু, গাছপালা, ঔষধ পত্র, গৃহ সামগ্রী। আদিবাসীদের শিখিয়ে ছিলেন ইউরোপিয়ান শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি। তবে তার আসল উদ্দেশ্য ছিল সোনা আবিষ্কার। সোনা আবিষ্কারের নেশায় তিনি ছিলেন লোভী আর নিষ্ঠুর।
আমেরিকার ইতিহাসে তার অন্য একটি পরিচয় হল, তিনি আমেরিকার মাটিতে কলোনাইজেশন এবং স্লেভারি বা দাস প্রথার প্রবর্তক ছিলেন। আদিবাসীদের অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় জোর পূর্বক সোনা খোঁজানো, করতে না চাইলে তাদেরকে নির্যাতন আর অত্যাচার, তাদেরকে বন্দী করে নিজেদের কাজে লাগানো, মহিলা ও শিশুদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ, এমন অনেক অন্যায় আর অহিতকর কাজের স্রষ্টা ছিলেন তিনি। তিনি এবং তার জাহাজের সদস্যরাই প্রথম বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও প্লেগ এর মত ভয়াবহ অসুখবিসুখ আদিবাসীদের মধ্যে সংক্রামিত করেছিলো।
পাবলিক স্কুলগুলোতে যখন আমেরিকার ইতিহাস পড়ানো হয় তখন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ইতিহাসও পড়ানো হয়। স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে আমার ছেলেদের একটি রচনা লিখতে হয়েছিল, 'ক্রিস্টোফার কলম্বাস কি একজন হিরো নাকি ভিলেন ছিলেন?' আসলে এই রচনাটি খুব কৌশলে স্কুলে শিশুদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যার কোনো সঠিক উত্তর নির্ধারণ করা হয়নি। তার কারন, হিরো বা ভিলেন দুটো উত্তরই শিক্ষিকার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল এবং শিক্ষিকা দুই ধরনের উত্তরেই সমান নম্বর দিতো। শিশুরা তাদের বাড়িতে যা শোনে, যা দেখে তাই তারা সঠিক মনে করে, তাই বিশ্বাস করে বড় হয়। চতুর্থ শ্রেণীর প্রতিটা ছাত্রছাত্রী তাদের রচনাটি লিখত, তাদের নিজ পরিবার বা অভিভাবকের থেকে পাওয়া জ্ঞ্যান বা মতামতের ভিত্তিতে।
আমেরিকানদের কারো চোখে কলম্বাস ছিলেন এক অনবদ্য সাহসী আবিষ্কারক। যিনি আগমন না করলে ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের কথা কেউ জানতেই পারতোনা অথবা ইতিহাসের পাতায় আমেরিকা আরও দেরী করে লিপিবদ্ধ হত। কলম্বাসের কারনেই আমেরিকা নামক ভূখন্ডটি সবার নজরে আসে। ইউরোপিয়ান দেশগুলো থেকে বিভিন্ন মানুষ এসে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভের চেষ্টা করে।
অন্য দিকে, কারো চোখে তিনি ছিলেন অত্যাচারী, অর্থপিপাসু শাসক। অর্থ আর সম্পদ গড়ার উদ্দেশ্যে যিনি অজস্র অসহায় মানুষের প্রাণ নিয়েছিলেন। বছরের পর বছর, শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে আমেরিকান আদিবাসীরা একটু একটু করে তাদের জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি, সহায় সম্পত্তি, এমনকি তাদের অধিকারের স্থান গুলোও ছেড়ে দিয়ে আসছে এবং শুধু অস্তিত্তের দাবি নিয়ে এই আমেরিকার মাটিতে পড়ে আছে। তাই আদিবাসী আমেরিকানদের কাছে কলম্বাস ডে একরাশ বেদনা ও কলঙ্কের স্বাক্ষর মাত্র। কোন কোন স্টেটে তাই এই দিনটিকে ইন্ডিজিনাস ডে বা আদিবাসী দিন ডাকা হয়।
পৃথিবী সৃষ্টির পরের থেকেই, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দুদিকের ভূখণ্ড বিদ্যমান ছিল। তবে ছিল তা আবিষ্কারের অপেক্ষায়। কাজেই নায়ক বা খলনায়ক যাই হোন না কেন, কলম্বাস ছিলেন জানা মহাদেশ এবং অজানা মহাদেশের মধ্যে এক সেতু বন্ধন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে তিনিই প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তার আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকেই হয়েছিল, একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
আমেরিকানরা বরাবরই তাদের নিজস্ব মতামতে বিশ্বাসী। বাক স্বাধীনতা এখানে খুব বড় একটি বিষয় যা প্রতিনিয়ত প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিজের অধিকারের কথা সর্বদা প্রকাশ করতে গিয়ে মহান আমেরিকানবাসীরা হয়ে চলেছে বিভক্ত, বিভাজিত। ধর্ম, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি, স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশ জ্ঞ্যান, বিজ্ঞ্যান চর্চা, সর্বক্ষেত্রে আজ তারা বিভক্ত। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত তারা নিজেদেরকে কোনো একটি নামে, কোনো একটি দলে তালিকা ভুক্ত করছে। চালিয়ে যাচ্ছে তর্ক, বিতর্ক, দ্বন্দ্ব, সংঘাত। জীবন ও জীবিকার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইমিগ্র্যান্টদের নিয়ে তৈরী আমেরিকান সমাজের মেল্টিং পটটি আজ টগবগ করে ফুটা বয়লিং পটে পরিণত হয়েছে।
An interesting writeup. Very much liked the co relation drawn between a successful leader and undivided country. Fully agree to the fact that a leader can bring about a change to the society, be it positive or negative. If a leader lacks the basic attributes of integrity, empathy, respect for others like your present leader, it can only lead to further division in a country.
ReplyDeleteকলম্বাসের নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের এক মর্মান্তিক মাশুল দিয়েছে আমেরিকার আদিবাসীরা। তারা এখন প্রায় বিলুপ্ত নিজ মাতৃভূমিতে। Immigration এর অসাধারণ মেধা এবং শ্রমের সমন্বয়ে আজ যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী আর দাপটশালী দেশ। কিন্তু সেই immigration এর সাথে অনিবার্যভাবেই এসেছে diversity, যা সেই কলম্বাসের প্রথম immigrant দের উত্তরসূরীদের করেছে শংকিত। হয়তো অবচেতন মনেই তারা আজ নিজেকে প্রশ্ন করে --- তবে কি এখন তাদের নিজেদেরই মাশুল দেবার সময়? এই insecurity তেই বুঝি আজ আমেরিকা এখন বিভক্ত! বিভাজন হয়তো symptom, অসুখ মনের ভেতর।
ReplyDeleteThank you for writing such an informative & enlightening piece. Reading it has been a learning experience for me. Now it is yet to see if the next leader of one of the most powerful countries in the world will be able to bring the nation together to grow or chose to bring destructive division.
ReplyDeleteThank you for an informative and interesting piece of writing that reminded me of the last line of a poem: কলম্বাসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাব নুতন দেশ। It is so crucial to have a good leader who can make it or break it. Let's just hope and pray for the former.
ReplyDeleteThis write up takes me back to my school life. I remember about reading Columbus's journey at that time. In my view he is a villain, because I can still recall him insulting the indigenous people in South America by labelling them as "Red Indians" and his toture towards them. You did a superb analysis. Well done.
ReplyDeleteখুব সুন্দর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ। ভালো লাগলো আর জানলাম কিছু নতুন বিষয় ।
ReplyDelete