জাগো

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস, World Mental Health Day (১০ই অক্টোবার, ২০২০)। 

WHO (World Health Organization) বছরের এই দিনটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে করোনা ভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে। পুরো বিশ্ব জুড়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষের আর্থিক সমস্যা, চাকরী হারানো, ব্যবসার ক্ষতি, স্বাস্থ্য সংকট, মানসিক চাপ, অসামাজিক জীবন যাপন, প্রিয়জন হারানো বা শিক্ষা মাধ্যম পরিবর্তন, এমন বহুবিধ ঘটনা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কতটা সুস্থ বা স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হচ্ছে এটা নিয়েই তাদের পর্যালোচনা। কারন, শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা একটি মানুষের জন্য খুবই জরুরী....কিন্তু আমি ভাবছি আর এক ধরনের মানসিক সুস্থতার কথা।  

গত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কিছু নির্মম ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বিশেষত ফেইসবুকে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। দেশে, বিদেশে সমগ্র বাঙালি জাতি হতবাক, স্তব্ধ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানব বন্ধন - আর তারই একটি অন্য প্রতিফলন, ফেইস বুক প্রোফাইল ছবি কালো করে দেয়া। যাতে এক দিনের জন্য হলেও পুরুষেরা বুঝতে পারে নারীদের প্রতিবাদের ভাষা, অবাক হয় তাদের ফেইসবুক অনুপস্থিতিতে অথবা সামিল হয় তাদের আন্দোলনে। 

এই ট্রেন্ডটি মূলত কে বা কারা প্রথম শুরু করেছে তা সঠিক করে আমি জানিনা। আর প্রোফাইল কালো করা আদতে কতটা কার্যকরী হয়েছে সেটা নিয়েও কোনো তর্কে যেতে চাইনা। আমি ফেইসবুকে এটার পক্ষে এবং বিপক্ষে দুধরনের মতামতই দেখেছি, নারীদের কাছ থেকে। প্রতিবাদের ভাষা একেক জনের একেক রকম। তাই মতবিরোধ হওয়াটা স্বাভাবিক।

নারীদের প্রতি সহিংসতা যুগ থেকে যুগান্তরে সর্বকালই চলে এসেছে। বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন দেশে, পুরো পৃথিবীতে। শুধু ধরন গুলো ভিন্ন। নারীরা লাঞ্জিত হয়েছে নিজের বাড়ীতে, অন্যের বাড়ীতে, অফিসে আদালতে, হোটেলে, হোস্টেলে, স্কুলে, বাসে, রাস্তায়, পার্কে, কিংবা খোলা প্রাঙ্গনে। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, কোথাও না কোথাও। কিন্তু খবর গুলো এখন বড় বেশী প্রকাশ পাচ্ছে, সবার নজরে আসছে সোশ্যাল মিডিয়ার কারনে। 

এই আধুনিক যুগে, একদল নারী যখন  Gender Inequality  আর  Women's Empowerment  নিয়ে সোচ্চার, নিজেদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছে, তখন তারাই থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছে, আমাদের নিরাপত্তাই যেখানে সুনিশ্চিত নয়, সেখানে  Equality তো অনেক পরের কথা। যে পুরুষের সাথে আমি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান জায়গায় দাঁড়াবো, সেই পুরুষের সাথে কি আমি আদৌ নিরাপদ?

প্রায় তিরিশ বছর আগে আমার ফেলে আসা বাংলাদেশ ছিল অনেক অন্য রকম। আমরা বড় হয়েছি মুক্ত স্বাধীন ভাবে, নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে কোনো অশ্লীল মন্তব্য, অপ্রীতিকর চাহনি, নোংরা ভাষা বা অস্বস্তিকর ইশারা সাধারণত আমাদেরকে জর্জরিত করেনি। মহল্লার ছেলেরা ছিল ভাই এর মত। পাড়ার মেয়েদের আগলে রাখতো, প্রয়োজনে এগিয়ে আসতো। বাবা চাচার বয়সী পুরুষেরা ছিল মুরুব্বীর মত। স্নেহ করতো, দোয়া করতো, ভালো চাইতো। 

কি করে হলো এই পরিবর্তন, এই অধঃপতন? সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়? এক বছর বয়সের শিশু থেকে শুরু করে ষাট বছর বয়সী মহিলা, কেউই যে রেহাই পাচ্ছেনা। আধুনিক, রক্ষণশীল, হাউস ওয়াইফ, চাকুরীজীবী, শিক্ষার্থী, মানসিক প্রতিবন্ধী, কেউই যে রেহাই পাচ্ছে না। 

কেন আজকের বাংলাদেশে প্রতিটা মেয়ে শিশু, প্রতিটা কন্যা সন্তানের বাবা-মা ভীত, শঙ্কিত? কেন আজকের বাংলাদেশে প্রতিটা বিবাহিতা এবং অবিবাহিতা নারী নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চিত? 

একটা ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই আর একটার জন্ম হচ্ছে। এক নরপশুর হিংস্রতা দেখে আর এক নরপশু জেগে উঠছে। এই সহিংস মানসিকতা, করোনা ভাইরাস এর মত ছড়িয়ে পড়ছে যুব সমাজে, তরুন সমাজে, পুরুষ থেকে পুরুষে, তাও সেই সোশ্যাল মিডিয়ারই  কারনে। কঠিন সাজা বা শাস্তির যেখানে ভয় নেই, কৃতকর্মের যেখানে ফল নেই, সেখানে তাদেরও কোনো ভয় নেই, অনুশোচনা নেই। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া চাই। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড বা জনসমক্ষে কঠিন শাস্তি, যা সবাইকে ভয় লাগিয়ে দেবে। কিন্তু দেশে আইনের রাস্তাতো অনেক লম্বা। কোনো শাস্তি কার্যকর হওয়ার আগে কাউকে দোষী স্যবাস্ত হতে হয়। দোষী স্যবাস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট তথ্য, প্রমান লাগে, সাক্ষী লাগে। কোনো অপরাধ হবার পর যখন রিপোর্ট লেখা হয়না, তথ্য প্রমান থাকেনা, সাক্ষী দিতে কেউ আসেনা, তখন বিচার কাজ এমনিতেই প্রলম্বিত হয়। ততদিনে আসামীরাও খালাস পেয়ে যায়। আর হুমকি, ধামকির মুখে বাকিরাও চুপ করে যায়। এমনটা তো ঘটে চলেছে বহুকাল ধরে।  

প্রতিটা পুরুষের জীবন শুরু হয় একজন মা থেকে। কোনো অপরাধী অপরাধ করার অনেক আগে থেকেই তার মানসিকতা গঠিত হয়। তাই শুরু করতে হবে একেবারে ঘর থেকে। শিশুকাল থেকে। মা বোনের কাছ থেকে। প্রতিটি ছেলে শিশুকে শেখাতে হবে মেয়েদের সম্মান করার কথা। তাদের বোঝাতে হবে মেয়েদের গুরুত্বের কথা। তার জীবনে মা বোনের ভুমিকার কথা। ছেলে শিশুটির বাবাকে দেখাতে হবে, কি করে স্ত্রীকে সম্মান দিতে হয়। ছেলেকে বোঝাতে হবে মায়ের মর্যাদা করতে হয়। সংসারে প্রতিষ্ঠা করতে হবে - ছেলে, মেয়ে যাই হোক দুজন সন্তানই সমান অংশের ভাগীদার। যেমন, বাবা আর মা দুজনেই সমান সম্মানের অংশীদার। 

পরিবারের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম গুলোতে আনতে হবে পরিবর্তন, একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকে। শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। এছাড়াও করতে হবে সামাজিক ভাবে কঠোর আইন প্রয়োগ, দৃষ্টান্তমূলক  শাস্তির ব্যবস্থা, কাউন্সেলিং এর সুযোগ, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা, মাদক দ্রব্য চোরাচালান বন্ধ, মেয়েদের কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা, মেয়েদের আত্মরক্ষার ট্রেনিং। গ্রামে গঞ্জে ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।

নারী পুরুষ উভয় নিয়েই আমাদের সমাজ। পুরুষের মোকাবেলা করতে আমাদেরকে, পুরুষেরই সাহায্য নিতে হবে। সুস্থ মানসিকতার পুরুষ। সকল পুরুষই খারাপ নয়, বিকৃত মনের নয়। এই কঠিন যুদ্ধে আমরা একলা লড়তে পারবোনা। এ রাস্তা দীর্ঘ, বন্ধুর, বিপদসংকুল। 

সকলকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। আত্মবিশ্বাসী, সাহসী নারীদের সাথে এগিয়ে আসতে হবে সহনশীল, সমঝদার পুরুষদের। সকল প্রকার খারাপ ভাবনা আর খারাপ প্রভাবকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। 

আমি জানি, বলা বা লেখা যতটা সহজ, করা ততটা সহজ নয়। কিন্তু, কোথাও না কোথাওতো শুরু করতে হবে। আমরা যে যার অবস্থান থেকেতো চেষ্টা করতেই পারি। 
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যেমন বলেছি, তেমন করে বলতে পারি, We are in this together!

আমি শুধু আমার ভাবনাটার কথাই বললাম - একজন নারী হিসাবে।

Comments

  1. A thorough and a comprehensive piece. Really hope that the Bangladeshi Govt. implements a radical change to their legal system to be able to deliver justice

    ReplyDelete
  2. Silence is complicity when the wait is too long! In Martin Luther King Jr.'s words, “Our lives begin to end the day we become silent about things that matter.” He also said, “In the end, we will remember not the words of our enemies, but the silence of our friends.”

    We have to fight this together with women.

    ReplyDelete

Post a Comment