কলুর বলদ

কিছুদিন ধরে বাংলা নিউজ গুলিতে একটা বিষয় বারবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। সৌদি আরব থেকে ছুটিতে বেড়াতে আসা এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক কোভিড ১৯ প্যান্ডেমিকের কারনে দেশে আটকা পড়ে গেছে।  এরই মাঝে তাদের অনেকের ভিসাও শেষ হবার উপক্রম। যেই কোম্পানি গুলো তাদেরকে  ভিসা দিয়েছিল এবং কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ করেছিল, তারা আর ভিসা নবায়ন করছেনা। বারো হাজার রিয়াদ সহ যথাযথ কাগজপত্র বাংলাদেশ থেকে পাঠালে, ভিসা নবায়ন করা যাবে। 

মার্চ মাস থেকে দেশে বসে থাকা এই কর্মহীন মানুষ গুলো কি করে এতোগুলো টাকা জোগাড় করবে যেখানে তাদের পরিবারের খরচ চালানোই তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছুটিতে বেড়াতে এসে তাদের সমস্ত সঞ্চয় শেষ। ধার দেনা করে তারা জীবন কাটাচ্ছে।  তাদেরকে ফেরত নেবার ইচ্ছে সৌদি সরকারের যেমন খুব একটা নেই। তেমনি তাদেরকে ফেরত পাঠাবার ইচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের ও খুব একটা নেই। সরকারের মতে, এরা নাহয় দেশেই কর্ম সংস্থানের কিছু একটা উপায় বের করুক। খবরে বলছিল, সরকারী খাতে ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে তাদেরকে ঋণ দেয়ার জন্য। কিন্তু ঋণের আবেদনের ক্ষেত্রে এতই শর্তাবলী আরোপ করা হয়েছে যে তাদের কারো পক্ষেই এতো কাগজ পত্র জোগাড় করা সম্ভব নয়। 

এর ফলশ্রুতিতে, ভীত, শঙ্কিত, হতাশা গ্রস্ত এই জনগোষ্ঠী লাগাতার সমাবেশ আর আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিমানের টিকেট আর সৌদি ভিসা অফিসের সামনে। কেউ, কেউ চাদর, বালিশ নিয়ে স্থায়ী আবাস গেড়েছে চারিদিকের ফুটপাথ গুলোতে। কেউ কেউ রাত কাটাচ্ছে মসজিদে। অল্প কিছু শ্রমিক তাদের ভিসা নবায়নে সক্ষম হয়েছে। আর অল্প কিছু তাদের নবায়নকৃত কাগজ পত্র নিয়ে সৌদির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। কিন্তু বেশীর ভাগ কর্মীই সহায় সম্বলহীন অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, ধর্না দিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয় অফিসে। 

এই ভয়াবহ আর দুঃখ জনক পরিস্থিতি থেকে এদের বাঁচাবে কে? কে বাড়াবে সাহায্যের হাত? হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া একজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি বলল, 'আমাদের প্রতি কি সরকারের কোনোই দায়িত্ব নেই?'  

দেশের অর্থনীতিকে বছরের পর বছর উজ্জীবিত করে আসছে যে শ্রমিক শ্রেণী, দেশের মানুষেরা গর্ব করে তাদের ডাকে 'রেমিট্যান্স যোদ্ধা'। নিজেদের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে, হাড় ভাঙ্গা খাটুনি করে বেতনের প্রায় সব টুকুই দেশে পাঠিয়ে দেয় এরা। বিদেশের মাটিতে মুখ গুঁজে পরে থাকে,  প্রিয়জনদের সুখের কথা ভেবে, আরাম আয়েসের কথা ভেবে। বিদেশের মাটিতে খুবই অল্প চাহিদায়, অল্প খরচে, একসাথে অনেক জন মিলে থেকে, এরা টাকা জমায়। কোনো মাসে সেই টাকা পাঠাতে এদের ভুল হয়না, পরিবার আর সংসারের কথা ভেবে। 

এরা তো অবশ্যই রেমিট্যান্স যোদ্ধা। কিন্তু বদলে এরা কি পায় দেশের মানুষদের কাছ থেকে? সরকারই বা কতটুকু ভাবে তাদের কথা?   

২০১৮ সালে রোজার ঈদে, 'কলুর বলদ' নামে চ্যানেল আই এর একটি নাটক টেলিভিশনে দেখে আমি মানসিক ভাবে  খুব আহত হয়েছিলাম। আপন জনেরা কি করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে, আর বহু দিন পরিবার থেকে দূরে থাকার কারনে বিদেশ থেকে আসা মানুষটির সরলতার সুযোগ নেয়, তা ছিল আমার চিন্তার অতীত। ষড়যন্ত্র করে সম্পত্তি থেকে বাদ দেয়া, বিয়ে করতে চাইলে সব রকম সুযোগ বন্ধ করা, স্থায়ী ভাবে দেশে চলে আসতে চাইলে চাপ দিয়ে আবার বিদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া, এমন অনেক কিছু দেখেছিলাম নাটকটিতে। এতো সুন্দর করে একটা নাটক বানানোর জন্য ভেবেছিলাম চ্যানেল আই কে ধন্যবাদ জানাবো।

 খুব সম্ভবত নাটকটি দেশে বিদেশে অনেক দর্শকের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছিল। আড়াই মাস পরে, কোরবানি ঈদে পেয়েছিলাম তাদের আরও একটি চমৎকার পরিবেশনা, 'কলুর বলদ ২'। যা কিনা আগেরটির সিকোএল। সেখানে দেখিয়েছিল, আপন মানুষদের চেহারা এবং মানসিকতা কত সহজে বদলে যেতে পারে শুধু মাত্র অর্থের লোভে। এতই বদলে যায় যে তারা আপন মানুষটিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য।  

বাংলায় কলু শব্দটির অর্থ, তৈলকার ব্যাক্তি যে ঘানিতে তেল তৈরি করে। আর কলুর বলদ হোলো এমন ব্যাক্তি যার ইচ্ছাশক্তি বা স্বাধীনতা নেই, কেবল অন্যের ইচ্ছা অনুসারে যাকে সর্বদা খাটতে হয়। বাস্তবের কলুর বলদরা অনেক বেশী  অসহায়। তারা এমনই এক ভাগ্য চক্রে আটকা পড়ে যার ভেতর থেকে ভালো না লাগলেও তাদের বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। তারা অবিরাম ঘানি টেনে যায়।  অনেক সময় তারা পরিবারের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। আবার অনেক সময় পরিবারের সদস্যের অভাব, অনটন আর সমস্যা গুলোই তাদেরকে বাধ্য করে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করতে, পারিবারিক অবস্থার উন্নতি করতে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, বিয়ের খরচ, যৌতূক, ভাইএর ব্যবসার উন্নতি, বাবা মার চিকিৎসা, পাকা দালান তৈরি, এমন আরও অনেক যুক্তিযুক্ত কারন তাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে এক অদৃষ্ট নিয়তির বেড়াজালে।  

এক গ্রীষ্মের ছুটিতে আমি আমার পরিবার এর সাথে প্যারিস এ বেড়াতে গিয়েছিলাম।  শহরের সবথেকে উঁচু পয়েন্টিতে, এক পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ। যার নাম   Sacre-Coeur Basilica। এখান থেকেই পাওয়া যায় পুরো প্যারিস শহরের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। হাজার হাজার টুরিস্ট সেখানে আসে, ছবি তোলে, ভিডিও করে। পাহাড়ের মাথায় বসে ওই ঐতিহাসিক ফরাসী নগরীটির সৌন্দর্য উপভোগ করে। কেউ কেউ আবার চার্চটির ভিতর ঢুকে হাজার বছরের পুরনো নির্মাণ শৈলী আর স্থাপত্য কলার নিদর্শন দেখে। 

আমাদের হাতে সময় ছিল খুবই কম। এই শেষ জায়গাটি দেখে আমাদের স্টেশন এ যাবার কথা আবার ফিরতি পথের ট্রেন ধরতে। অসংখ্য মানুষের ভিড় ছাপিয়ে, একটু জায়গা করে আমরা চটজলদি কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করছিলাম।  হঠাৎ কে যেন বাংলায় বলে উঠলো, 'আপা, প্লিজ আপনাদের ব্যাগ গুলো সামলে রাখেন। এই জায়গাটা চোর, পকেটমার দিয়ে ভরা।' পাশে তাকিয়ে দেখি, একজন বাঙালি খেলনা বিক্রেতা চাদর পেতে মাটিতে বসে খেলনা বিক্রি করছে। আমি তাকাতে উনি বলল, 'আপনি ভাইয়ার সাথে বাংলায় কথা বলছিলেন। তাই বুঝলাম, আপনারা বাঙালি।' চারিদিকে হাজার হাজার বিদেশী পর্যটকদের  রকমারি ভাষার কথোপকথনের মাঝ থেকে নিজের মাতৃভাষা শুনে, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বাঙালি পরিবারকে সাবধান করার কি অসাধারণ দায়িত্ব বোধ তার! কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল।  

কথায় কথায় উনার থেকে জেনেছিলাম, উনি সিলেট অঞ্চল থেকে বহু দিন আগে প্যারিসে এসেছেন। উনার পরিবার সিলেটেই থাকে। আটকে যাওয়ার ভয়ে আর কখনো দেশে ফেরত যাননি। তবে নিয়মিত টাকা পাঠান পরিবারকে। বলতে বলতে উনার চোখ দুটো ভিজে উঠছিল। উনার কাছ থেকে আমার ছেলেদের জন্য দুটো খেলনা কিনলাম। দাম জানতে চাইলে বলল, 'আপা, যা মনে হয় দেন। আপনারা বাঙালি, আপনাদের কাছে কি চাবো।' আমাদের কাছে ইউরো যা বাকি ছিল তার প্রায় সবটাই দিয়ে দিলাম। উনি অনেক খুশী হলেন। আর বললেন, 'আপা, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন একবার দেশে যেতে পারি।' এই লোকটির সাথে আর কোনো দিন দেখা হবে কিনা জানিনা। তবে দেশের প্রতি এই দেশ ছাড়া মানুষটির নিখাদ টান ও ভালোবাসার অবিস্মরণীয় উদাহরণ আজীবন মনে থাকবে।  

এরকম রেমিট্যান্স কর্মীরা ছড়িয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সৌদি আরব, ইউ এ ই, কাতার, কুয়েত, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউ এস, ইউ কে, ইউরোপ এর বিভিন্ন দেশে। দৈনন্দিন কর্ম ক্ষেত্রে, রাস্তা ঘাটে, চলতে ফিরতে, কোনো বাঙালির সাথে দেখা হলে, পরিচয় হলে, এরা উজার করে দেয়। বাঙালি ট্যুরিস্টকে পথ নির্দেশনা দেয়া, বাঙালি রেস্তোরার সন্ধান দেয়া, লোকাল  কারেন্সি ভাঙ্গিয়ে দেয়া, মালামাল টেনে দেয়া, স্যুভেনিওর এর খোঁজ দেয়া, দর্শনীয় জায়গাগুলো চিনিয়ে দেয়া, এমন  অনেক কাজে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি ভাইবোনদের দেখলে। অনেক সময় ফলমূল, পানীয় বিনা মূল্যে দিয়ে দিতে চায়। বেড়াতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা আমার অনেক শহরে অনেকবার হয়েছে। 

দেশ ও জাতির প্রতি এতো মমত্ববোধ, এতো উদারতা, এতো টান আর কারা অনুভব করে? সম্ভবত দেশে থাকা কোনো বাঙালি নয়। প্রিয়জনদের ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকার কষ্ট এরা জানে। এরাই জানে, যতদিন আয় করতে পারবে, টাকা পাঠাতে পারবে ততদিনই এদের কদর, প্রিয়জনদের কাছে। তবুও, দেশ মাতৃকার প্রতি তাদের টান এতোটুকুও কমেনা। স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যবোধ এতোটুকু কমেনা। যারা দেশে যেতে পারেনা,  বছরের পর বছর প্রতীক্ষার দিন গুনে আর আশায় বুক বাঁধে, একদিন হয়তো দেশে ফেরা হবে।

দেশে ফিরলেও তাদের বিভিন্ন রকম হয়রানির খবর প্রায় খবরের কাগজে আসে। এয়ারপোর্টে মালামাল ও দেহ তল্লাশি, টাকাপয়সা ছিনতাই,  সুটকেস থেকে দামী উপহারসামগ্রী চুরি, দুর্বিত্তের হাতে মারধোর হেনস্তা, ভিসা নবায়নে ভোগান্তি, চাকুরি হারানো, সুচিকিৎসার অভাব, এমন অনেক ধরনের অন্যায়, অপমান ও অভিযোগের কথা আমরা শুনে থাকি কলুর বলদদের থেকে। দেশের অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও অবিরাম অবদানের কথা যেন সরকারী মহলের চোখেই পড়েনা - চোখের পানি মুছতে মুছতে অনেক রেমিট্যান্স কর্মীরা বলেন।  

 দেশের মাটিতে অথবা প্রবাসে বসে, সুখী স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে, বাস্তবের  কলুর বলদদের কথা আমরা কয়জন ভাবি?

Comments

  1. Without any hesitation we can address our workforce as the real patriots who have sacrificed their lives to run the economy with their hard earn foreign remittance. As if they have taken the over all responsibilities not only to look after their family members but to care for Bangladesh as a nation. I congratulate you for writing such a heart touching piece depicting the true representatives of Bangladesh. Hats off to our KOLUR BOLODS

    ReplyDelete
  2. It is estimated a total of $1.8bn will be sent back via remittance to loved ones in 2020 from this Kolur Bolods overseas. The sacrifices all these heroes make to make their families' lives better is a salutary lesson for all - many of those who toil in Saudi, Kuwait and other ME areas and sacrifice so much, living in squalor to allow them to send back the vast majority of their disposable monthly income to those who need that money more. Indian workers suffer the same fate, but the work Bangladeshis are offered are at much lower salary levels, meaning the remittance per head is much lower than most other countries including Indians.
    The end result is quite sad really: the government boasts a healthy current account thanks to the $1.8bn, which receives applause from overseas investors, but few drill down to how this has been achieved. This is thanks to those who have fled abroad, willing to endure a tough existence but happy to do so to support the many who depend on them doing well so that they can share in their "success".

    ReplyDelete
  3. brilliant and emotive piece of writing

    ReplyDelete
  4. "কলুর বলদ" বাংলাদেশি migrant workers face additional stigma during this pandemic: " migrants face segregation and confinement at both ends. In their host countries, they are treated as an unwanted underclass, and when they return to Bangladesh they are isolated socially and ostracized by neighbors who fear they are COVID-19 carriers." according to this article. https://www.migrationpolicy.org/article/covid-19-pandemic-profoundly-affects-bangladeshi-workers-abroad-consequences-origin

    বাংলাদেশ সরকার কি তাদের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করবে? হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতি!

    ReplyDelete
  5. Pen is mightier than the sword. Well, perhaps you have used the modern technology instead of a pen but the saying proves that an article like yours can act as a catalyst for making us aware of what's going on in our community and what can be done to make reforms to the system.

    ReplyDelete

Post a Comment