একটি স্বতন্ত্র জেনেরেশন


আমরা ছুটে চলি এপার থেকে ওপারে। দিন নেই, রাত নেই, এক মুহূর্তও অবকাশ নেই। আমরা করে যাই যোগাযোগ, চালিয়ে যাই কথোপকথন, মানুষগুলোর সাথে। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে। ওদের কথা বলার ভাষা ভিন্ন, চিন্তা করার তরিকা ভিন্ন, উপলব্ধি করার অনুভূতি ভিন্ন। একমাত্র আমরাই পারি ওদের মাঝে বন্ধন গড়তে। 

কারন আমরা যে কানেক্টর - এজেন্ট - কমুনিকেটর, একালের সাথে ওকালের।

পড়তে পড়তে আপনারা ভাবছেন, আমি কি নিয়ে কথা বলছি? আমি কথা বলছি জেনেরেশন গ্যাপ নিয়ে যা বর্তমান সময়ের সব থেকে আলোচিত একটি কনসেপ্ট, একটি অদৃশ্য দেয়াল যা আমাদের মাঝে এক বিরাট বিভাজন তৈরি করেছে। যা আমাদের জীবন যাত্রাকে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রন করছে। 

বহমান সময়ের স্রোতে পৃথিবীর বুকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসছে, যাচ্ছে, আর তাদেরকে নামকরন করা হচ্ছে। বেবি বুমারস, জেনেরেশন এক্স, ওয়াই, জেড। নির্দিষ্ট সালের গণ্ডির মধ্যে না হলেও, মোটামুটি কাছাকাছি সময় সীমার মধ্যে আপনার জন্ম হলে, আপনি সেই জেনেরেশন এর অন্তর্ভুক্ত। 

আমাদের যাদের জন্ম ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৯ র মধ্যে, তাদেরকে বলা হয় জেনারেশন এক্স। এই প্রজন্মের মানুষেরা এমনই এক বিচিত্র কালের প্রত্যক্ষদর্শী, যে তারা জীবনের শুরুতে দেখেছে একরকম, আর তাদের জীবনটা শেষ হবে  সম্পূর্ণ এক বিপরীত পরিবেশে। তাই আমাদেরকে বলা হয় The most unique generationঅর্থাৎ আমরা একটি অনন্য বা অদ্বিতীয় প্রজন্ম।

আমরাই একমাত্র প্রজন্ম যারা দুই ভাষাতেই পারদর্শী। আমরা আমাদের পিতামাতার মুখের ভাষা পড়তে পারি। তারা কি চান, না চান তা অনুধাবন করতে পারি। আবার আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কার্যকলাপও বুঝতে পারি। তাদের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড  এর ভাষাও আমাদের জানা। 

কি করে? কারন আমরা যে দুই সময় কালেরই ভাগীদার। পরিবর্তনের আগে এবং পরিবর্তনের পরে। 

১৯৮০র পরপর ঘটে গিয়েছিল এক বিশাল টেকনলজি বুম বা প্রযুক্তিগত উত্থাপন। আর তারই রেশ ধরে  পৃথিবীর মানুষ এসে পরেছে অ্যানালগ দুনিয়া থেকে ডিজিটাল দুনিয়াতে।  আমাদের ঠিক পরবর্তী প্রজন্মকে বলা হয় মিলেনিয়ালস বা জেনেরেশন ওয়াই। ঠিক তাদের জন্মের  (১৯৮০-১৯৯৪) পরপরই এই প্রযুক্তির রকেটটি ঊর্ধ্ব গতিতে ছুটতে থাকে। আর তা পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায় দশ পনের বছরের মধ্যেই। কাজেই মিলেনিয়ালসরা যখন বড় হচ্ছে, সেই সময়টাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার সুত্রপাত ঘটে। আবির্ভাব ঘটে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব প্রমুখ। 

এর পরবর্তীতে যাদের জন্ম (১৯৯৫-২০১০), তাদের ডাকা হয় জেনেরেশন জেড বা জি। যারা আমাদের অর্থাৎ জেনেরেশন এক্স এর সন্তান সন্ততি। জেন জি'র জন্মই হয়েছে স্মার্ট ফোন, আই প্যাড আর  ট্যাবলেটকে সাথে করে। স্মার্ট ফোনের আগে জীবন যাত্রা কেমন ছিল তা সম্পর্কে এদের বিন্দু মাত্র ধারণা নেই। 

এদের পারিবারিক জীবন, শিক্ষা জীবন, সামাজিক জীবন সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ইন্টারনেট এর মাধ্যমে। এরা কম্যুনিকেশন এ বিশ্বাসী। এরা টেক্সটিং এ বিশ্বাসী।  এরা ব্যবহার করে স্ন্যাপ চ্যাট, ইন্সটাগ্রাম। এরা পরিবর্তনে উৎসাহী। আর তা আনতে চায় সম্মিলিত বা দলীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আমরা জেনেরেশন এক্সরা এদের লালন পালন করছি। আমরা এদের বাবা,মা। এই অদম্য তরুন প্রজন্মের সাথে আমাদের আগের জেনেরেশন আমাদের বাবামা'র যোগাযোগ স্থাপন আমরাই করিয়ে দিচ্ছি। যেন পুরাতন এর সাথে নতুন এর যোগ। 

জেন এক্স কে বলা হয় সবচেয়ে পরিপূর্ন বা ভারসাম্যপূর্ন জেনারেশন। আমরা পরিবর্তন দেখেছি, পরিবর্তিত হয়েছি। এক সময় আমরা রেডিও, ভিসিয়ার, ওয়াকম্যান, ক্যাসেট প্লেয়ার দেখেছি। আবার পরবর্তীতে আমরা ডিভিডি প্লেয়ার, প্লে স্টেশন, এমপিথ্রি প্লেয়ারও চালাতে শিখেছি। কোনো কিছু নিয়ে আমরা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করিনা। আমরা ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড এর ব্যাপারে উৎসুক, তবে আমরা ইন্টারনেটে গা ভাসাই না। 

আমরা স্বনির্ভর, আত্মবিশ্বাসী, ধৈর্যশীল। আমাদের বাবামা বা মুরুব্বিজনেরা যখন বুঝতে অক্ষম হয় ইউটিউব কি, স্ট্রিমিং কি, ব্লগ কি, হ্যাশ ট্যাগ কি, আমরা তখন সোজা ভাষায় সহজ কথায় তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। স্মার্টফোন কি করে চালাতে হয় তা শেখাই। 

আবার যখন ছেলেমেয়েরা এসে আমাদের বলে, Hey Mom, check out this coolest Meme. তখন গুগল করে আমরা নিজেরাই বের করি Meme মিম কি, টিকটক কি। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রজন্মটিকে বলা হয় America's forgotten middle child। বাড়ির দ্বিতীয় সন্তানের মনে যেমন অনেক দুঃখ থাকে যে সে, বড় সন্তান বা ছোট সন্তানের মত পিতামাতার বিশেষ ভালোবাসার পাত্র নয়, তাদের কথা বেশীর ভাগ সময় পিতামাতা ভুলেই যায়, অনেকটা সেই রকম। অনেকে মনে করে, আমাদের আগের প্রজন্ম বেবি বুমারস আর পরের প্রজন্ম মিলেনিয়ালসদের মাঝখানে পড়ে গিয়ে, আমরা একটা স্যান্ডউইচ জেনেরেশন।  

যে যাই ডাকুক, গর্ব করার মত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার নিদর্শন আমাদের ভাণ্ডারে আছে। চাঁদের মাটিতে প্রথম অবতরণ (১৯৬৯), জার্মানের বার্লিন ওয়ালের পতন (১৯৮৯) আমাদের স্মৃতি কোঠায় বিদ্যমান। পেলে বা ম্যারাডোনার মত অনবদ্য ফুটবল খেলোয়াড়দের বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা জীবন আমরা দেখেছি। আমাদের সময়েই প্রথম পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি এর ব্যবহার শুরু হয়। ইন্টারনেট দুনিয়াতে গুগল এবং অ্যামাজন এর উদ্ভাবক দুজন ব্যাক্তিই জেন এক্স প্রজন্মের।  

আমরাই সর্বশেষ সেতু বন্ধন, আগের সাথে পরের, ওপারের সাথে এপারের। আমরা আমাদের পিতামাতার কথা শুনেছি, সম্পূর্ণ বিপরীত আমাদের ছেলেমেয়েদের কথাও শুনেছি। এই দীর্ঘ জীবন যাত্রায় আমাদের অনেক কিছু দেবার আছে। এর সবই আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আলোকিত। 

তাই পরবর্তি প্রজন্মের কাছে বলছি, সময় থাকতেই আমাদের থেকে গ্রহন কর। আমাদের যা কিছু ভালো তা আগলে রাখো। আদর্শ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, মূল্যবোধ, নীতিবোধ, সব কিছু।  জেনেরেশন এক্স যখন পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে, আমরা যখন আর থাকবো না, তখন সব কিছু বদলে যাবে। বর্তমানের চাইতেও অনেক বেশী বদলে যাবে। 

আমরা যখন থাকবো না, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা সব অনুভূতি গুলোর রং হয়ে যাবে ফিকে। ভালোবাসাহীন, আবেগহীন ছাড়া ছাড়া মানুষ গুলোর হৃদয় ভরে যাবে যান্ত্রিকতায়। এই প্রাণবন্ত পৃথিবীটা আটকে যাবে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডসদের মায়ার জালে।    

Comments

  1. Total agreement with theory of the Sandwich generation, the generation that is having to constantly compromise, readjust and reorganise emotionally & physically with the ongoing changes that is taking place.

    ReplyDelete
  2. Belonging to the digital immigrant category, I have to deal with people from different generations on a daily basis. Your insights are greatly relatable to the mindsets of the traditional generation and helpful in understanding and shaping the future generation. Love your positivity, creativity and unconventional writeups. - Ardent admirer.

    ReplyDelete
  3. Gen X accelerated the tech boom through innovation and brought the whole world much closer together. And now the technology is advancing faster than X for sure, balancing the boomers, millennials and beyond, as you observe correctly. Language, art, music, fashion, literature, culture in general is evolving through the closeness of our world today. Three cheers for Gen X !!!

    ReplyDelete
  4. Excellent! It is really an important and relatable topic for today's younger generation. Thank you so much for writing about such a significant subject.

    ReplyDelete

Post a Comment