মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ
মাইক হাতে নিয়ে মেয়েটি দ্বিধান্নিত চোখে তাকাল। কি বলবে বুঝতে পারছেনা। সম্মানীয় বিচারকটিকে অনুরোধ করল আবার জিজ্ঞেস করতে। তিনি আবার ও করলেন প্রশ্নটি। "মনে কর, তোমাকে তিনটি উইশ দেয়া হয়েছে। একটি নিজের জন্য, একটি পরিবারের জন্য, আর একটি তোমার দেশের জন্য। তুমি কোন উইশটি বেছে নেবে এবং কি উইশ করবে?"
মেয়েটি আরও একটু সময় নিয়ে বলল, "আমি দেশের উইশটি বেছে নেব। কারন, আমাদের দেশে খুব সুন্দর একটি সমুদ্র সৈকত আছে। আরও আছে পাহাড়, পর্বত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।"
বিচারকটি বিরক্তির সাথে মেয়েটিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আমরা যেমন উইশ করিনা যে কালকে যেন আমি খুব সুন্দরী হয়ে যাই। অথবা, কালকে থেকে যেন আমার পরিবার অনেক ধনী হয়ে যায়। এমন কিছু একটা ভেবে ঠিক মত উত্তর দাও।
মেয়েটি চুপ করে থাকল। খুব সম্ভবত সে উইশ (Wish) শব্দটির মানে বোঝেনি।
আরও একজন প্রতিযোগিনীকে প্রশ্ন করা হল, "আমাদের দেশের তিনটি জিনিসের নাম বল যেটা দিয়ে তুমি তোমার দেশকে বাইরের ওয়ার্ল্ড এর কাছে উপস্থাপন করতে পারবে।" প্রতিযোগিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল, "আমার খুবই নার্ভাস লাগছে। মাথা ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেছে। কিছুই মনে আসছেনা।"....
আমি এতক্ষণ ধরে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ সুন্দরী প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ডের কিছু অপ্রত্যাশিত মুহূর্তের বর্ণনা দিচ্ছিলাম, যা গত কয়েক বছর ধরে দেশে, বিদেশে আমাদের সবাইকে অবাক আর হতাশ করে দিয়েছে।
ফাইনাল রাউন্ডে যে দশ বা বারো জন প্রতিযোগিনী আসতে সক্ষম হয় - তারা নিংসন্দেহে সুন্দরী এবং সাহসী। কিন্তু তারা কি যথেষ্ট প্রস্তুতি রাখে, বিশ্বের মঞ্চে নিজের দেশ বা বাংলাদেশকে উপস্থাপন করার?? হ্যাঁ, হতে পারে নার্ভাসনেস বা অনভিজ্ঞতা তাদেরকে একটু এলোমেলো করে দেয় বিচারকদের সামনে, বড় হল ভর্তি দর্শকদের সামনে। কিন্তু বেসিক কিছু ধারণা বা জ্ঞ্যান তাদের অবশ্যই থাকা উচিত যা তাদের নিজেদের সম্পর্কে, পরিবারের সম্পর্কে এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের স্বদেশ সম্পর্কে।
আমার মনে হয়, এই দায়িত্বটি পুরাপুরি বর্তায় আয়োজকদের উপর। তারাই কিন্তু যাচাই, বাছাই করে শয়ে শয়ে সুন্দরীদের মাঝ থেকে দশ জন সেরা সুন্দরীকে তুলে নিয়ে আসে। শুধু মেকাপ বা অ্যাপিইয়ারেন্স নয়, ফর্মাল পোশাক বা র্যাম্প ওয়াক নয়, তাদেরকে পরিপূর্ণ ভাবে গ্রুমিং বা তৈরি করার দায়িত্বও আয়োজকদের।
আর যারা বিচার কাজে নিয়োজিত থাকেন, আমাদের সম্মানীত বিচারক প্যানেল, তাদের ও কি উচিত নয় একটু ভাবনা চিন্তা করে, পুরনো বিউটি প্যাজেন্ট বা সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলি সমীক্ষা করে, কিছু বস্তু নির্ভর বা সমকালিন ভিত্তিক প্রশ্ন করার। কারন, বিশ্বের সেরা সুন্দরী যিনি নির্বাচিত হন, তাকে কিন্তু প্রায়শই সমাজ সচেতনতা মূলক কিংবা দেশের উন্নয়ন ধর্মী কোন কাজে নেমে পড়তে হয়।
ভালো উত্তর পেতে চাইলে ভালো প্রশ্ন করতে হবে যা সংগতিপূর্ণ। একজন বিচারকের প্রশ্নের ধরন কখনই এমন ব্যাক্তিগত বা অস্বস্তিকর হওয়া উচিত নয়, যেমন "মনে কর তুমি বাড়ি ফিরে দেখলে, তোমার হাসবেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড খুব অন্তরঙ্গ অবস্থায় তোমার সবথেকে প্রিয় বান্ধবিটির সাথে। তুমি তখন কি করবে?".... প্রিয় বান্ধবী বনাম প্রিয় পুরুষ বেছে নেয়ার মধ্য দিয়ে আর যাই হোক, বিশ্ব সুন্দরী হওয়ার যোগ্যতা প্রকাশ পায়না। বিষয়টি নিতান্তই তার ব্যাক্তিগত।
আপনারা যারা এতক্ষণ ধরে এই ব্লগটি পড়ছেন, তাদেরকে বলতে চাই, এটাই কিন্তু আমার লেখার মূল বিষয় বস্তু নয়। এবার মূল প্রসঙ্গে আসবো।
আমি আজ লিখতে বসেছি হাজারো বাঙালী মিস ওয়ার্ল্ডদের নিয়ে যারা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, এই বিশ্ব মঞ্চে আমাদের দেশ তথা বাংলাদেশকে পরিচিত করছে। কিভাবে?
বাংলাদেশেকে পেছনে ফেলে হাজার হাজার নারী/মহিলা/মেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ জীবন কাটাচ্ছে। তা সে পড়াশোনার মাধ্যমে হোক কিংবা কর্ম সংস্থান কিংবা হোক প্রবাসী বাঙালির সাথে বিবাহ বন্ধনে। বিদেশের মাটিতে নিজেদের জীবন গড়তে গিয়ে, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে, তারা অসংখ্য অবাঙালি বা বিদেশীদের সান্ন্যিধে আসছে। কিন্তু তারা কি তাদের বাঙ্গালিয়ানাকে একটুও বিসর্জন দিচ্ছে?
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, শিক্ষিকা, জার্নালিস্ট, বৈজ্ঞানিক, নার্স, ব্যবসায়ী, থেরাপিস্ট, শেফ, গায়িকা, লেখিকা, সমাজ সেবিকা, এমন অসংখ্য পেশায়, শিক্ষা আর যোগ্যতা দিয়ে সফল ভাবে কাজ করে যাচ্ছে প্রবাসী বাঙালি নারীরা। অন্য দেশীদের সাথে তাল মিলিয়ে, নিষ্ঠা আর দক্ষতার সাথে, আত্মবিশ্বাস এর সাথে তারা এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। দেশ ও সমাজের উন্নয়নের পথে রাখছে অসংখ্য অবদান। তাদের এই প্রাপ্তি, এই সফলতার জায়গাটি অনেক পরিশ্রম, চেষ্টা আর বুদ্ধি দিয়ে অর্জন করতে হচ্ছে। কোন চাচা-মামা কানেকশনের মাধ্যমে নয়।
তাদের এই দীর্ঘ চলার পথে প্রতিনিয়ত তারা কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। "Where are you from?" কোন অফিস মিটিং বা সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি পরিচিত প্রশ্ন। আর তখন তারা গর্বের সাথে নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেয়, বাংলাদেশকে পরিচিত করে একজন সফল নারীর স্ব স্ব অবস্থান থেকে। "I am from Bangladesh, an independent country. We got our freedom in 1971 through a nine months long war of sacrifice and resilience."
"What language do you speak?" বা তোমার মাতৃভাষা কি?, কারো কারো কৌতূহল সূচক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলে, "I speak in Bangla, the 5th most spoken language in the world (by native speakers).
In 1952, we didn't give up our native language Bangla, under oppression and brutality. That's why, The United Nations has declared February 21 as the International Language Day."
আমেরিকানরা প্রায়ই ভূগোল সম্পর্কে তাদের সীমিত জ্ঞ্যানের পরিচয় দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তারা যখন চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করে, "Bangladesh??...Where is that?"
বাঙালি মেয়েটিকে তখন গর্বের সাথে বলতে হয়, "It's a small country next to the east of India, right by the Bay of Bengal. Do you know we have the longest sea beach in the world?"
দৈনন্দিন জীবনে বিদেশের মাটিতে বাঙালি নারীরা কোন না কোন ভাবে সবসময়ই বাংলাদেশকে উন্মোচন করছে। কোন প্রতিবেশী, বন্ধু বা সহকর্মীকে নিজের হাতের রান্না খাইয়ে বলছে " Can you feel the rich taste and flavor? This is our famous Bengali cuisine"
তার কোন বিদেশিনী বান্ধবীকে হয়তো একটি সুন্দর শাড়ী দেখিয়ে বলছে "Saree is one of the most graceful and sophisticated women's attire in the world." হয়তো বিদেশিনী বান্ধবিটিকে মহা উৎসাহে শাড়ি পড়ানো শিখাচ্ছে।
বিদেশের মাটিতে জন্মানো দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানদের অবিরাম বাংলা চেনাচ্ছে, বাংলা ভাষা শেখাচ্ছে এই বাঙালী মায়েরাই। আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চারা কত সুন্দর করে দুটি ভাষাই রপ্ত করছে এবং গর্বের সাথে নিজের বাবামা, আত্মীয় পরিজনের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলছে। অসংখ্য ভাষা সৈনিকের রক্তের প্রতিদানতো আসলে তারাই দিচ্ছে।
একবার ভেবে দেখুন, এরাই তো প্রকৃত মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ। বাঙালি ঐতিহ্য, বাঙালি সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য, বাঙালি খাওয়া, বাংলা নববর্ষ, বাংলা ভাষা আর কে বা কারা এতো সহজে, এতো উদারতার সাথে, এতো গর্ব নিয়ে সবার চোখের সামনে তুলে ধরতে পারছে।ইংরেজিতে মিস টাইটেলটি ব্যবহার করা হয়, মিস বা মিসেস যে কোনটিই হতে পারে বোঝাতে। তাই আমার এই লেখাটি, আমেরিকা সহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালী নারীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম। পুরো পৃথিবীবাসীর কাছে, বাংলাদেশকে চেনানোর যে গুরু দায়িত্বটি তারা গ্রহন করেছে, সেই ক্লান্তিহীন কাজটিতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ।
তারা মিস নাকি মিসেস, এটা কোন মুখ্য ব্যাপার নয়।
তারা বাঙালি মিস ওয়ার্ল্ড - বাংলাদেশের প্রতিনিধি, এই বিশ্বমঞ্চে। তারাই প্রকৃত মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ।
“I long to accomplish a great and noble task, but it is my chief duty to accomplish small tasks as if they were great and noble.” – Helen Keller
ReplyDeleteHelen Keller was the first deaf-blind person to earn a Bachelor degree and she is known around the world as a symbol of courage in the face of unimaginable odds....a true inspiration!!
DeleteYou really make a great choice when you pick a topic no doubt as it is not only remarkable but also authentic. The line that stands out for me is that, " You need to deliver a good question to be able to expect a great answer. In a similar manner the judging panel should have some credibility to expect participants to be able to present certain standard. The entire show is a JOKE.
ReplyDeleteI totally agree with you that the true Miss or Mrs Bangladesh are those who are relentlessly representing Bangladesh mainly in foreign countries with their own unique identity.
Proud of you.
Knowing very well that beauty contests are no longer limited to physical traits, i think the organizers in Bangladesh need to make an effort to highlight more on intelligence and talent. This stands for the Judges as well. Being an owner of a beauty parlor, or an actor does in no way, make one qualified to be a judge. I believe, in the era of globalization stringent policies should be followed regarding such contest, as the content no longer remains within the domains of an individual country.
ReplyDelete