ডগ হাউস
আমার ছোট ছেলেটি প্রায়ই একটা কুকুর আনতে চায় বাড়ীতে pet হিসেবে। কি মুশকিল! কোনো ধরনের প্রাণীকে বাড়ীতে এলাউ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন নয়, এটা বোঝাতে আমার হিমশিম খেতে হয়। ও যখন খুব ছোট ছিল তখন থেকেই এই প্রাণী প্রীতি আমার চোখে পড়ত। ও যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ত তখন প্রায়ই স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে গল্প করত, ওর কোনো টিচার বা বন্ধুদের কথা যারা আজকে তাদের pet সম্পর্কে স্কুলে আলাপ করেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে আমি গল্প গুলো শুনতাম, আর pet এর সাথে তাদের জীবন যাত্রাটা কেমন, তা বোঝার চেষ্টা করতাম। অনেক কিউট নামও জানতে পারতাম। যেমন হল Coco, Buddy, Rocky, Max, Pixie, Boots ইত্যাদি।
কিছুদিন পরে টের পেলাম, আমার ছেলেটি আসলে আমাকে বা তার বাবাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। একদিন সরাসরি জিজ্ঞেসই করে বসলাম....এই সেরেছে! সেও তার বন্ধুদের মত বাড়ীতে 'পেট' রাখতে চায়। কোন ধরনের প্রাণী চায় জিজ্ঞেস করতে জানিয়ে দিল, কুকুর। কি ভয়ঙ্কর কথা! কুকুর আমি ভীষণ ভয় পাই। অবশ্য অন্যান্য প্রাণীও যে ভয় পাই না তা নয়। কেন কুকুর? বিড়াল বা খরগোশ নয়, ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম। সে জবাব দিল, কুকুরের মত লয়াল আর অনুগত প্রাণী এ ভুবনে আর দ্বিতীয়টি নেই, যে তার জীবন দিয়ে হোক প্রভুকে রক্ষা করবে। এই ব্যাপারে বিড়াল খুবই স্বার্থপর। সে তার নিজেরটা ছাড়া কিছুই বোঝে না। আর খরগোশতো এতই নিরীহ আর চুপচাপ যে সে বাড়ীতে থাকা, না থাকা একই কথা। উত্তরটি মনে ধরল। কিন্তু প্রস্তাবটি নয়। বাড়ীতে কোনো ভাবেই কুকুর রাখা চলবে না।আমার বড় ছেলেটি যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে, তখন তার 'পেট' রাখার ইচ্ছেটা শুনে আরও বেশী অবাক হতে হয়েছিল। সে একটা জিরাফ রাখতে চেয়েছিল বাড়ীতে। কারন জিজ্ঞেস করলে নিঃসঙ্কোচে বলেছিল, যেহেতু জিরাফের গলা অত্যধিক লম্বা, তাই জিরাফটিকে বাগানে রাখলে তার মাথাটি দোতালার জানলায় এসে ঠেকবে। আর আমার ছেলে খুব সহজেই জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াতে পারবে। তাকে আর কষ্ট করে নীচে নেমে জিরাফের খানাদানার ব্যবস্থা করতে হবেনা। কি চমৎকার কার্যকরী চিন্তা!
আমার ছেলেদেরকে বলা হোল, বাসায় কোনো ধরনের 'পেট' রাখা চলবে না। তা সে কুকুর হোক, বিড়াল হোক, হাতি কিংবা জিরাফ। আমি খুব জোর মাছ এলাউ করতে পারি, তবে সেগুলো সম্পূর্ণ ভাবে তাদেরকেই রক্ষনা বেক্ষন করতে হবে। এই কথায় তাদের উৎসাহে দারুণ ভাটা পড়ল। তারা মাছ পালতে কোনো রকম ইচ্ছা পোষণ করল না।
কিন্তু এবার এলো আমার পালা, জবাব দেবার....কেন আমি বাড়ীতে কুকু্র, বিড়াল রাখতে দেবো না। লোমশ একটি চারপায়ী জন্তু সারা বাড়ি ঘুরঘুর করছে, আর বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করে গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে বা জিভ দিয়ে আলতো করে চেটে দিচ্ছে....এই দৃশ্যটি চিন্তা করলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। রাতের বেলা বিছানায় শুতে এসে দেখব, জন্তুটি আমার আগেই বিছানা দখল করে বসে আছে, আর আমাকে দেখে খুশীতে লেজ নেড়ে নেড়ে জানান দিচ্ছে....না বাবা না। এটা আমি সজ্ঞানে হজম করতে পারবোনা।
আমি ছেলেদের বললাম, I am very allergic to animals। আমার কাছাকাছি কোন লোমশ প্রাণী এলে, আমার হাঁচি, কাশি, সর্দি শুরু হয়ে যায়। শরীরে র্যাশ বেরোতে শুরু করে। বিশেষ ভাবে এও বললাম, তারা যখন বড় হয়ে যার যার নিজ বাড়ীতে আলাদা থাকবে, তখন তারা যা খুশী পালতে পারবে। তাদের কেও কিছু বলবে না। আমার বড় ছেলে 'পেট' এর ব্যাপারে আর কোনোদিন কিছু বলল না। খুব সম্ভবত সে ঝামেলা গুলো আঁচ করতে পেরেছিল। খাওয়ানো, গোসল করানো, বাইরে হাঁটতে নেয়া, লোম ছেঁটে দেয়া, বছর গেলে টিকা দেয়া, আরও কত কি।
পশ্চিমা জাতির মধ্যে খুব বিচিত্র একটা জিনিস লক্ষ্যনীয়। এরা এদের অনুভূতি বা এক্সপ্রেশন গুলোকে খুবই সুরক্ষিত বা গার্ডেড অবস্থায় রাখে। সুখ, দুঃখ, ভয়, হতাশা, বিরক্তি কিংবা রাগ কোনোটাই এরা অতিমাত্রায় প্রকাশ করেনা। আর তার সুত্র অনুযায়ী, প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা বা মমতা প্রকাশের বেলায়ও এরা অধিক কার্পণ্য দেখায়।
এই জাতিগত ধর্মের একটি বিশাল ব্যতিক্রম হলো, প্রাণী প্রীতি। পোষা প্রাণী বা pet এর ব্যাপারে এরা খুবই অনুরাগী। এতো বেশী মাত্রায়, যে প্রাণীটিকে নিজের পরিবারের একজন সদস্যর মত বিবেচনা করে এবং তার সুযোগ সুবিধার জন্য যা কিছু প্রয়োজন করে। পাশে বসিয়ে খেতে দেয়া, কোলে নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া, সাবান দিয়ে গোসল দেয়া, অসুখ হলে সেবা করা, কোনো কিছুতেই এরা পিছপা হয়না। আর প্রাণীটি অসুস্থ থাকলে বা মারা গেলে তো কথাই নেই। দিনের পর দিন এদের মন খারাপ থাকে। ডিপ্রেশন হয়, সেপারেশন অ্যানজাইটি হয়। মোটিভেশন এর অভাব ফিল করে। প্রাণীদের প্রতি তাদের এই স্নেহ আর ভালোবাসা প্রকাশের অভিব্যাক্তি গুলো দেখে আমি অভিভূত হই। এই গুনাবলী নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং মানবিক।
কিন্তু একই সাথে এটা দেখেও আশ্চর্যান্বিত হই, পিতামাতা বাড়ীতে বেড়াতে এলে এরা কেমন যেন বিরক্ত হয়।অন্য শহর থেকে বেড়াতে এলে, পিতামাতা কতদিন বাড়ীতে থাকতে চায় বা থাকার সম্ভাবনা আছে, এই আশংকায় নিমজ্জিত হয়। একই শহর থেকে বেড়াতে এলে তাদেরকে বাইরে কোন এক রেস্টুরেন্টে খাইয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করার ব্যবস্থা নেয়।
ছেলে-মেয়ে আঠারো বছর হলেই বাড়ী থেকে তাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। ছেলে মেয়েকে জানায়, অনেক তো করলাম তোমাদের বড় করতে। এখন নিজেরটা নিজে বোঝো। পার্ট টাইম কাজ করে কলেজের লেখাপড়ার লোন শোধ কর।
তিন মাসের ছোট্ট শিশুকে পাশের রুমে বেবি ক্রিবে ঘুম পারায়। যাতে বাবা মা'র প্রাইভেসি নষ্ট না হয়, আর শিশুটি স্বাবলম্বী হয়ে বড় হয়।
ভাই বা বোনের কাছ থেকে যতোটা সম্ভব দূরে বা অন্য স্টেটে চলে যেতে চায়। পাছে রেষারেষি বা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আর একই শহরে থাকলে, ভাই বা বোনের স্ত্রী/স্বামী এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক করতে এরা কুণ্ঠা বোধ করেনা।
আগে থেকে না জানিয়ে বাড়ীতে অতিথি এলে, দরজা থেকেই খালি মুখে তাদের বিদায় করে দেয়। ভালো মনে কোনো প্রতিবেশী কিছু জিজ্ঞেস করলে, তাকে অনধিকার চর্চা ভেবে অতিরিক্ত কৌতূহলী প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য করে।
কাজের পরে বাড়ী ফিরে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পোষা কুকুরটিকে বাইরে হাঁটাতে নেবার ইচ্ছে বা সময়, দুটোই এদের হয়। কিন্তু ইচ্ছে হয়না, বৃদ্ধাশ্রমে মাসের পর মাস পড়ে থাকা বৃদ্ধ মা-বাবার অসহায়, ব্যকুল, পথ চেয়ে থাকা মুখ খানি দেখবার।
কেন জেনারেশন এর পর জেনারেশন একই ধারায় চলতে থাকে? কেন প্রাণী প্রীতির পাশাপাশি পরিবার প্রীতিও, এদের চিন্তা চেতনায়, ধ্যান ধারণায় অন্তর্ভুক্ত হয়না? অনেকে বলে, Love and Care only reciprocates. তবে কি সেটাই কারন?
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, সন্তানের অবহেলা দেখার মাঝে কি আসলে নিজের তরুন বয়সের প্রতিফলনই দেখা যায়?....
আমি শুধু বোঝার চেষ্টা করি। যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফেরত আসি।
আমার ছোট ছেলেটি এতো সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। আজ পর্যন্ত সে প্রায়শই আমাকে মনে করিয়ে দেয়, সে তার নিজ বাড়ীতে কুকুর পুষবে। তা ভালো কথা।
সেই সাথে এটাও বলে যে আমি যখন তার বাড়ীতে বেড়াতে আসব, সে মনে করে কুকুরটিকে 'ডগ হাউসে' আটকে রাখবে। আম্মু যাতে কোনও ভাবে ভয় না পায়। আমি তাতেই খুশী!!
:)
ReplyDeleteআমার এক কলিগ একদিন খুব খুশী হয়ে জানাল যে তাদের বাসার পোষা সাপটি দুই সপ্তাহ নিখোঁজ থাকার পর বাথটাবের মধ্যে পাওয়া গেছে। শুনে আমার মুখে হাসি, অন্তরে YIKES!!! তার বাবা-মা'য়ের কোন গল্প কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।
সন্তান যদি কুকুর পুষে খুশী থাকে তো হাঁফ ছেড়ে বলব --- বাঁচা গেল!!! কুকুর dog house এ রাখবে মানে হয়তো ভাবছে বাবা-মা বাসায় আসা যাওয়া করবে মাঝে মধ্যে --- দারুন ব্যাপার!!!
This is an extremely relatable topic considering my mother's displeasure in having furry pets in the house. I have also managed to come to settlement of having my dog at my own place.
ReplyDeleteHowever, I personally believe with the culture and upbringing we are accustomed to, we have enough love to share both with our loved ones as well as pets.
Great topic. Thoroughly enjoyed reading it. Clearly highlights the cultural difference and values between the East and the West.
ReplyDelete