মাছে-ভাতে বাঙালি
আমার মত যারা প্রথম জেনারেশন বাঙালি বিদেশে বসবাস করছেন এবং আপনাদের থেকে যাওয়া দেশটিতেই আজীবন থাকতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছেন, তাদের অনেকেই আমার এই লেখাটি পরে একমত হবেন। হয়তোবা মনে মনে হাসবেনও এই ভেবে যে, 'আমিও তো একই দ্বন্দ্বে ভুগি এবং প্রায়ই এই সমস্যার সম্মুখীন হই'। আমার এই লেখাটি সেই সব বাঙালিদের উদ্দেশ্যে যারা তাদের প্রবাস জীবনে এক ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধ বা মানসিক সংঘাত আমাদের নিজেদেরই সৃষ্ট, তবে এর শেষ কোথায় আমরা জানিনা।
১৯৯২ সালের কথা। আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি কলেজে অ্যাডমিশন নিয়ে এসেছি আন্ডার গ্র্যাজুএট করবার জন্য। আমার অল্প বয়সের চোখে তখন অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা। আমি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করব। আমার স্বপ্নের দেশ এটি, এখানে আমি সবসময় আসতে চেয়েছি। কেও একজন বলেছিল, এখানে টিকে থাকতে গেলে তোমাকে অনেক চেষ্টা আর পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে পরিবর্তন করে এদেরই একজন হয়ে উঠতে হবে। কঠিন বাংলায় যাকে বলে 'সাংস্কৃতিক অভিযোজন' বা Acculturation.
শুরু হল আমার যুদ্ধ। পরিবর্তন এর যুদ্ধ। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যে্র মধ্যে বিশাল ব্যবধান। কৃষ্টি,সংস্কৃতি,জীবনবোধ,মূল্যবোধ সবকিছুই এখানে ভিন্ন। আর তারই প্রতিফলন দেখা যায় প্রতিদিন,প্রতিনিয়ত। আমি আমার শৈশব,কৈশোর এ আহরিত সমস্ত বিদ্যা,বুদ্ধি, জ্ঞান গুলোকে নেড়ে চেড়ে,ঝেড়ে মুছে আবার নতুন ঢঙে,নতুন রঙে সাজালাম।
আমি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলা অভ্যাস শুরু করলাম। দেশে থাকতে ইংরেজি পরেছি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। তবে সেটা পাঠ্য বিষয় হিসাবে। আর এখন সেটা কথোপকথনে প্রয়োগ করতে প্রথম প্রথম বেগ পেতে হল। যে কোন ভাষাতেই গ্রামার এর পাশাপাশি একটা নিজস্ব লোকাল স্টাইলও থাকে। এই যেমন কথার ফাঁকে,ফাঁকে বিভিন্ন ফ্রেজ বা অভিব্যক্তি প্রকাশ করা। আমি তাও রপ্ত করলাম। এই যেমন "Oh, my God!" অথবা "Give me a break!" অথবা "You know what I mean!".
আস্তে আস্তে খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এলো। চটপটি, সিঙ্গারা, ঝালমুড়ি, ফুচকা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তার পরিবর্তে বার্গার, পিজা, স্যান্ডউইচ, ফাস্ট ফুড হল কলেজের খাবার সঙ্গী। উপরন্তু অভ্যাস করলাম সোডা বা ঠাণ্ডা পানীয়। তবে অবশ্য, এই যুগের ইয়াং জেনারেশন বাঙালিরা দেশে সব ধরনের ফাস্ট ফুড এই অভ্যস্ত। তাদের কাছে কোন কিছুই অপরিচিত নয়।
আমি যেই সময়ে দেশ ছেড়েছি, সেই সময়ে কোক বা ফানটা খাওয়াটা একরকম বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ত। কারন ওগুলো ছিল সাধারণ ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এদেশে এসে দেখলাম, কলেজের সহপাঠীরা পানির পরিবর্তে বিভিন্ন পানীয় খেতেই বেশি উৎসাহী। আর এটা কোন বিলাসিতা নয়,বরং একটা নিয়মিত অভ্যাস।
শহর এর সাবওয়ে সিস্টেম সম্পর্কে আমার বিশেষ জ্ঞ্যান অর্জন হল। যেটা আর কিছুই না, মেট্রোরেল ছাড়া। তবে সাবওয়ে ম্যাপ খুব ভাল করে ধাতস্থ না করলে, খুব সহজেই যে কেও পৌঁছে যেতে পারে শহরের অন্য কোন অপরিচিত প্রান্তে। আমার এমন অভিজ্ঞতা বেশ কয়েক বার হল। তবে ভাগ্যক্রমে কোন উদার ট্রেন যাত্রী বা পথচারীর নির্দেশনায় আমি আমার গন্তব্য স্থলে সঠিক ভাবেই পৌঁছালাম।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উপমহাদেশে শাসন করেছিল দু'শো বছর। সেই সুত্রে আমরা বাঙালিরা চিরটাকাল ব্রিটিশ ইংলিশ পরেছি, শিখেছি। আমেরিকায় এসে উপলব্ধি করলাম, আমেরিকান ইংলিশ অনেক আংশেই আলাদা অথবা এরা আলাদা করে নিয়েছে। Lift নয় Elevator, Chips নয় French Fries, Football নয় Soccer, Biscuit নয় Cookie, Postbox নয় Mailbox, Petrol নয় Gas, Flat নয় Apartment, অথবা Full Stop নয় Period, একে একে এমন আরও অনেক শব্দ আমার দৈনন্দিন অভিধানে এসে যুক্ত হল।
ক্রমান্বয়ে জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগে তার সবকিছুতেই আমি এ দেশীয় কায়দায় অভ্যস্ত হলাম। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল, আমি এখানে আজীবন ধরে আছি। আমার চিন্তা, চেতনা, ধ্যান, ধারণা সবকিছুতেই যেন পরিবর্তন এলো।
কলেজের গ্র্যাজুএশন শেষ করে কয়েক বছর চাকরী করলাম। আমার জ্ঞ্যানের ঝুড়িতে তখন আর একটি জিনিস যুক্ত হয়েছে, আমেরিকান কর্পোরেট কালচার। শুধু কথা বলা বা খাওয়া দাওয়া নয়,চালচলন বা বস্ত্র পরিধান নয়,মার্কিনীদের মত ভাবতে পারা অথবা তারা কি ভাবছে তা উপলব্ধি করা,আমার জীবনযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যোগ করল। অনেক অনেক দিন আগে আসা ভিত,শঙ্কিত,দ্বিধা দ্বন্দ্বে আক্রান্ত - সেই আমি আর নেই। আমি গর্বিত আর আনন্দিত হতে থাকলাম এই ভেবে,যে আমি এই ইমিগ্র্যান্ট কালচার এরই একজন সদস্য। বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মিশ্রণে গঠিত 'মেল্টিং পট' বলে খ্যাত নিউইয়র্ক শহরের যে গর্ব, আমি তারই একটি সক্রিয় অংশ।
ধীরে ধীরে চিত্রপটের পরিবর্তন হল।
বিবাহোত্তর আমি যুক্তরাষ্ট্রের অন্য একটি অঙ্গরাজ্যে চলে এলাম। সেইখানে গড়ে উঠলো আমার নতুন জীবন। আমাদের সংসারে দুইজন নতুন সদস্য যোগ দিল। আমার দুটি ছেলে। তারা হল জন্মগত সুত্রে মার্কিন নাগরিক। আর নাগরিকত্ব সূত্রেই তাদের কোন কিছু জানার বা শেখার প্রয়োজন হল না। তাদের ভাষা, খাওয়া, আচার, ব্যবহারে দেখা গেল, যে দেশের মাটিতে তাদের জন্ম, সেই দেশেরই প্রচণ্ড প্রভাব।
আমি আবিষ্কার করলাম, তারা হাঁটটি, মাটিম টিমের পরিবর্তে Itsy, Bitsy Spider কবিতাটি পড়তেই বেশি উৎসাহী। এক যে ছিল রাজার পরিবর্তে Jack and the Bean Stalk গল্পটি শুনেই বেশি আনন্দিত হয়। সাপ লুডু খেলার চাইতে মনোপলি বা স্ক্র্যাবেল খেলতে অধিক আগ্রহী। কনকনে শীতের সকালে, আমার যখন পিঠা খেতে মন চায়, তখন তাদের খেতে সাধ জাগে ডোনাট বা মাফিন। আর জাগবে নাই বা কেন। এই পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা আর এদের মানুষগুলো যে আমার ছেলে দুটির জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপাড়ের ভূখণ্ডটির সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই।
আসলে,জন্মগত সুত্রে যেই জায়গা বা পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়,সেই সম্পর্ক চিরন্তন। সেই সম্পর্ক মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
এটা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা ভয় আমাকে ঘিরে ধরল। আমি আতংকিত হলা্ম এই ভেবে,তাহলে কি আমার সন্তানেরা বাংলাদেশ কে চিনবে না? জানবে না? বাঙালি শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি,বাঙালি খাওয়া,বাংলা ভাষা এটার মূল্য দেবেনা? কিন্তু তা কি করে হয়? আমিতো মনে প্রানে ঠিকই বাঙালি। ভৌগলিক অবস্থান পরিবর্তন, আমার অন্তরের সত্ত্বাকে তো পরিবর্তন করতে পারেনি।
বহু বছর আগে যে পরিবর্তন সাধন এর জন্য আমি যুদ্ধে নেমেছিলাম,সেই পরিবর্তন এর বেড়াজাল থেকে আমার সন্তান দুটোকে বাঁচাবার জন্য আমি আজ ব্যাকুল। যে গল্পের প্রথম অধ্যায়ে আমি ছিলাম জয়ী,সেই গল্পেরই পরবর্তী অধ্যায়ে এসে আমি কি একজন পরাজিত সৈনিক? বাংলাদেশে না জন্মালে,বাঙালি হওয়াটা কি খুব জরুরী? নাকি শেকড়ের সন্ধান করবার দায়িত্ব ছোট, বড় প্রতিটি মানুষেরই আছে।
বিগত বছর গুলিতে আমার মনে পরে,‘মাছে-ভাতে বাঙালি’এই এক্সপ্রেশনটা একদিন আমার ছেলেদের বোঝাতে গিয়ে, আমার চূড়ান্ত ঘাম ঝরেছিল। আমি ওদের বলেছিলাম,রসগোল্লা আর ইলিশ মাছ আমাদের বাঙালিদের খাওয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আমার ছেলেরা চোখ বড় বড় করে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,"What's the big deal with Hilsha fish?" তাদের আখাংকিত উত্তরটি কি হওয়া উচিত আমার সঠিক জানা ছিলনা।
আর একদিন,আমার ছেলে এসে আমাকে বলল,"Can I call you Mom, instead of Ammu, in front of my friends?" আমি মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিলাম,"Sure! why not?"
আবার যখন দেখি আমার ছেলেরা, নিকট আত্মীয় স্বজন ছোট বড় সবাইকেই 'তুমি' বলে সম্বোধন করে। কারন ইংরেজিতে সকলেই YOU । আমার মনের ভিতর শুরু হয়ে যায় আরও একটি যুদ্ধ। এতদিন যা কিছু করবার চেষ্টা করেছি,তার বিপরীতে যাওয়ার যুদ্ধ। এ যেন অদ্ভুত এক 'উভয় সংকট'। যার সমতা রক্ষা করা অসম্ভব না হলেও, খুবই কঠিন।
'How much change is necessary and 'How much would be enough', এ দুটির মাঝেই চলতে থাকে দ্বন্দ্ব.....You know what I mean!
Outstanding..you are an incredible writer no doubt..enjoyed reading thoroughly
ReplyDelete:) You have eloquently described the path of the 1st generation immigrant! পরিবর্তনই জীবনের একমাত্র অপরিবর্তিত সত্য।
ReplyDeleteOutstanding writing. Looking forward to reading more!
ReplyDeleteAnother piece of writing I can relate to, at a great extent; since I just moved to another country and just getting acquainted with the changes and differences in the new life; alongside the reluctance to move away from the roots. Loved it!
ReplyDeleteVb
ReplyDeleteExcellent! Your this life journey is really very inspirational. I salute you.
ReplyDelete