আর্তি

এই কবিতাটি, বহু দিন আগে আমার কিশোরী বয়সের মনের এক সহৃদয় আর্তি। পর পর ঘটে যাওয়া শিশু নির্যাতন এর কিছু ঘটনা একবার সংবাদ পত্র গুলোতে আসতে থাকে। পেটের দায়ে কাজ করতে আসা বাড়ির কাজের মানুষ গুলোর গল্প, আমার মনের খুব গভীরে দাগ কেটে যায়। আমি আবেগে আন্দোলিত হয়ে এই কবিতাটি লিখি।

 
আনন্দ আর ভালোবাসায় ভরা এই সুন্দর পৃথিবীর উল্টো পিঠে ওদের বাস,
ওরা পরিচয় পায় মানবতার অপর পিঠের, যে পিঠ কালো আর কলঙ্কময়।
এক অসহনীয় অন্ধকারের আবর্তে ঘেরা।
ওদের জন্মের ধরনটা ভিন্ন, তাই পাওয়ার ধরনটাও ভিন্ন।
চারিদিকে যখন শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলন সোচ্চার,
ঠিক তখনি এক অভিশপ্ত যুগে আটকে পড়া, ওরা কিছু নির্যাতিত ছেলেমেয়ে।
ছমিরন, মমতাজ, কুসুম, পারুল, কালাম, জয়নাল অথবা আব্দুল।

টেলিভিশনে শিশু নির্যাতনের নাটক দেখে বাড়ির কর্তাটির চোখে জল আসে,
ছোট্ট ইশিতার অভিনয় দেখে বেদনায় বুক ভেঙ্গে যায়।
তার কর্ত্রীটি, শিশু শ্রমের প্রতিবাদে মিছিলে শ্লোগান দেয়,
আর দিনের শেষে ক্লান্ত দেহে ঘরে ফেরে। 
তাদেরই বাড়ির ভেতর চলে অন্য নাটক, অন্য খেলা,
অন্য কিছু চরিত্র তাতে অভিনয়  করে।
ভালো মানুষের মুখোশধারী পরিচিতরা, রাতের আধারে ধারন করে অপরিচিত রূপ।

একই বয়সী দুজন - ভিন্ন ব্যবহার, ভিন্ন আচরণ।
বাড়ির মেয়েটি পায় জামা, জুতো, খেলনা 
কাজের মেয়েটি - চড়, থাপ্পর, লাথি, অকথ্য নির্যাতনের বোঝা।
শরীরে দগদগে ঘা নিয়ে বাথরুমের কোনে পারুল কাঁদে,
অসহ্য যন্ত্রণায় মুখ কুঁকড়ে যায়।
গরম, উত্তপ্ত খুন্তির ছ্যাকায় তার শরীর ঝলসে দেয়া হয়েছে।
অপরাধ সামান্য, ভাত রাঁধতে দেরী করে ফেলেছিল।
বিনিময়ে খেসারত দিয়েছে করায় গণ্ডায়। 
সেদিন কাপড় ইস্ত্রি করতে ভুলে গেল আব্দুল, অনেক কাজের চাপে মনে ছিলনা
তাই ইস্ত্রি দিয়ে তার দেহ পুড়িয়ে দেয়া হোল, দেয়া হোল বেদম প্রহারের ক্ষত চিহ্ন।
 
কি ভয়াবহ, পাশবিক আর সাংঘাতিক ওদের জীবনের এই চালচিত্র।
এতো গেল একটি ঘরের খবর, এমন রয়েছে অসংখ্য, অগণিত।
শোষক ও শোষিতের এই সম্পর্ক বহুযুগের, বহুকালের।
এর দৃশ্যগুলো চেনা, মানুষ গুলোও চেনা,
কারন আমরা নিজেরাই এর স্রষ্টা, নিজেরাই এর শিকার।
ভাগ্যের দোষে কোন নীচু ঘরে জন্মিয়ে 
আমাদেরই ছোট ভাই বা বোন এর বলি হয়।
তার কচি, কোমল হাত দুটি দিয়ে, আস্তাকুঁড়ে জন্মানোর ঋণ শোধ করে।

ওরা দীন, হীন, দরিদ্র - ওরা একদল অভাগা শিশু,
নিপীড়ন, অত্যাচার, আর নির্যাতন ওদের খেলার সাথী।
বইয়ের বদলে ওরা হাতে নেয় রিকশার হাতল, কলের চাকা, ইট ভাঙ্গা হাতুর
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শেখে জীবনের সংজ্ঞা।
হে মানব জাতি, তোমরা মুখে বল সমাজসেবার কথা, আর কাজে কর
ঠিক বিপরীত। যেন একই মুদ্রার এপিঠ - ওপিঠ।
তোমরা কি দিতে পারো না ওদের একটু স্নেহ, একটু মমতা, কিংবা স্বাধীনতা?
বন্দী পাখিরা যেমন পায় মুক্তির আস্বাদ, ঠিক তেমনি ওদের জীবনটা বদলে দাও।
শেখাও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কেমন হয়, মানবতা কারে কয়।
নিজের ছেলেমেয়ের মতই ওদের বুকে তুলে নাও।
চাঁদের এপিঠ, ওপিঠ সমান হয়ে যাক। চাঁদ হোক শুধুই সুন্দর, কলঙ্কহীন, অপরূপ।


Comments

  1. অসাধারণ, নিস্তব্ধতার এই আর্তি!

    ReplyDelete
  2. Your writing skills are magnificent. I am totally amazed by the way you have reflected upon such subtle emotions, which has touched the very core of my heart. Keep up with the brilliant work

    ReplyDelete
  3. This poems reflects the emotions of all those children who are abused physically and mentally. Considering it to be a common occurrence in our country, you have managed to touch the right chords which is their emotions! Spectacular portrayal of a serious issues in Bangladesh.

    ReplyDelete

Post a Comment